খাগড়াছড়িতে সরকারি অধিগ্রহণকৃত ভূমিতেই ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না ভূক্তভোগীরা

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা এম এ হান্নান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের(বিএসসি ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং) যাবতীয় অবকাঠামো নির্মানে উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণকৃত ভূমিতেই ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না ভূক্তভোগীরা। জেলাতে গোলাবাড়ি ঠাকুরছড়াস্থ বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ হান্নান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের জন্য সরকারি অধিগ্রহণকৃত ভূমির অনুকূলে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্থরা। ভূমি অধিগ্রহণ নীতিমালা অনুযায়ী বাজার দরের তিন গুন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা রয়েছে, তবে দেড় গুনও পাচ্ছেন না তারা। জেলা প্রশাসন বলছে, কাগজ-কলমের বাইরে কিছুই করার নেই তাদের।

বিএসসি বা স্নাতক পর্যায়ে প্রকৌশল শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়াতে দেশের চার জেলায় চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়েছে। কলেজগুলো হলো ঠাকুরগাঁওয়ে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, নওগাঁয় মো: আব্দুল জলিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, খাগড়াছড়িতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ হান্নান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং নড়াইলে প্রকৌশলী খান হাতেম আলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ১২হাজার ২২কোটি ৩৯লাখ টাকা।

খাগড়াছড়িতে এমএ হান্নান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সদর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়নের ঠাকুরছড়া এলাকায়(পিটিআই সংলগ্ন)। কলেজ ক্যাম্পাস ও যাবতীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১৯৫৮সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান আইন অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৮.০০একর ভূমি অধিগ্রহণের পর প্রকল্প পরিচালক আলী আক্কাস-কে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণের পর তা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেয়া হলেও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি ভূমির অধিগ্রহণের মামলাগুলো। ক্ষতিপূরণের অর্থও পায়নি কেউ। অধিগ্রহণকৃত ৮.০০একর ভূমির বিপরীতে ক্ষতিপূরণের জন্য এখন পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছেন ৮৭জন ক্ষতিগ্রস্থ ভূমি মালিক।

এর মধ্যে একজন ক্ষতিগ্রস্থ ভূমি মালিক হলেন সদর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়নের মহালছড়া এলাকার বাসিন্দা ও প্রাক্তণ কার্বারী মংচাই মগ(৬৮)। অধিগ্রহণকৃত ৮.০০একরের মধ্যে তার একারই ২.৭০একর ভূমি রয়েছে।

প্রাক্তণ কার্বারী মংচাই মগ বলেন, ‘আমার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমির ২.৭০একর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভূমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে। তবে এর ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে না আমাদের। বাজার দরের তিন গুন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা থাকলেও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে দেড় গুনেরও কম। বর্তমান বাজার মূল্য যেখানে দেড় লাখ টাকা শতক, সেখানে প্রতি শতকের বর্তমান মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৬৬হাজার টাকা।’

একই এলাকার রেদা মগ(৬৪) এর ১.৬০একর ভূমি পড়েছে অধিগ্রহণের আওতায়। শুনানীর মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝে নেয়ার জন্য তাকেও জেলা প্রশাসন থেকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। তবে নোটিশে উল্লেখিত জমির দামে সন্তুষ্ট নন তিনিও।

রেদা মগ বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের ওই ভূমি শতক দেড় লাখ টাকায় অর্থাৎ ৪০শতক বিক্রি হচ্ছে ৬০লাখ টাকায়। সেই হিসেবে প্রতি ৪০শতক জমির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা ১কোটি ৮০লাখ টাকা। অথচ নোটিশে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতি ৪০শতক ভূমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ৭৯লাখ টাকা।’

হেডম্যান পাড়া এলাকার বাসিন্দা ক্যজরী মারমা বলেন, ‘আমার ৬শতক ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আমার ভূমির বর্তমান বাজার দর প্রতি শতক প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেই হিসেবে প্রতি শতকে সাড়ে ৪লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। অথচ প্রতি শতকে মাত্র ১লাখ ৯৯হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছে জেলা প্রশাসন। যা বর্তমান বাজার মূল্যের দেড় গুনেরও কম।’

এমন আরেকজন ক্ষতিগ্রস্থ খাগড়াছড়ি শহরের আরামবাগ এলাকার ব্যবসায়ী মো: রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রায় ১.০০একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, অথচ নোটিশ দেয়া হয়েছে মাত্র ৩০শতক ভূমি অধিগ্রহণের। বাকী ৭০শতক ভূমি অধিগ্রহণের নোটিশ এখনো পাইনি। যদিও এর জন্য আমরা লিখিতভাবে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদনও করেছি।’

এছাড়া যে ৩০শতক ভূমির নোটিশ পেয়েছেন তাতেও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী মো: রুহুল আমিন।

এদিকে লকডাউনের কারণে স্থগিত করা হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ মামলাগুলোর শুনানী। করোনার এই পরিস্থিতিতে ঠিকঠাক বলাও যাচ্ছে না কবে হবে শুনানী কার্যক্রম।

খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মোহাম্মদ সাঈদ মোমেন মজুমদার জানান, লকডাউন শেষ হলে পুনরায় নোটিশের মাধ্যমে শুনানীর তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে।

এছাড়া ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না পাওয়া প্রসঙ্গে মোহাম্মদ সাঈদ মোমেন মজুমদার বলেন, ‘বিষয়টি সত্য যে ক্ষতিগ্রস্থরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। তবে এর দায় কোনভাবেই জেলা প্রশাসনের নয়। মূলত সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে ক্রেতা-বিক্রেতারা নিম্ন দরে ভূমি রেজিষ্ট্রি করে থাকেন। এর ফলেই এমনটা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অধিগ্রহণের প্রজ্ঞাপণ জারীর তারিখ হতে পূর্ববর্তী এক বছরের কেনা-বেচার মূল্য দেখে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়। যদিও আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই এলাকায় বর্তমানে প্রতি শতক জমি প্রায় দেড় লাখ টাকায় কেনা-বেচা হচ্ছে। তবে সরকারি রেজিষ্ট্রার কিন্তু সেই কথা বলছে না। রেজিষ্ট্রিতে প্রতি শতকের মূল্য দেখানো হয়েছে ৬০থেকে ৬৫হাজার টাকা। আমরাতো ডকুমেন্টের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি না।’

প্রসঙ্গত, ডিপ্লোামা কিংবা এইচএসসি পাসের পর খাগড়াছড়ির এম এ হান্নান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিতে অধ্যয়নের সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা। কলেজটিতে সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার সায়েন্স, অ্যারোনটিক্যাল, জেনেটিক, এনভায়রনমেন্টাল, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থাকার কথা রয়েছে।

এছাড়া অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে কলেজের প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন(ল্যাবসহ), অধ্যক্ষের বাসভবন, শিক্ষক ডরমেটরি, শিক্ষক-কর্মকর্তার কোয়ার্টার, মাল্টিপারপাস বিল্ডিং, সেন্ট্রাল কম্পিউটার ল্যাব, লাইব্রেরি ও রিসার্চ সেন্টার, অডিটোরিয়াম, সেমিনার এবং এক্সিবিশন হল, নারী-পুরুষ হোস্টেল, বাউন্ডারি ওয়াল, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন, গভীর নলকূপ, পানির পাইপলাইন, আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজারভার, ওভারহেড পানির ট্যাংক, অভ্যন্তরীণ সারফেস ড্রেন, মুুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ, পুকুর ও বৃক্ষ রোপণ, গ্যাস লাইন সংযোগ স্থাপন করার কথা রয়েছে।