খুলনায় সন্ত্রাসের ভয়াল ছায়া: মহেশ্বরপাশায় ভোরের গুলিতে আতঙ্ক
খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা এলাকায় ভোররাতে গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে দুটি গ্রাম। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) ভোরে খুটিরঘাট ও কার্তিককুল এলাকায় দুটি বাড়িতে অর্তকিত হামলা চালায় সশস্ত্র একটি দল। তারা গুলি ছুড়ে ও ভাঙচুর করে পালিয়ে যায়।
এই গুলিবর্ষণের সিসিটিভি ফুটেজ ইতোমধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল ও পত্র-পত্রিকার মাল্টিমিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ভিডিওটি প্রচারিত হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়।
ফুটেজে মোটরসাইকেলে আসা সশস্ত্র ব্যক্তিদের গুলি চালিয়ে পালানোর দৃশ্য দেখা যায়, যা দেখে সাধারণ মানুষ ক্ষোভ ও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমজুড়ে নাগরিকরা সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এ নিয়ে প্রশাসনের দিকেও উঠেছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান।
এ ঘটনায় থানায় দুটি মামলা হয়েছে—একটিতে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে, অন্যটি অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে। আসামিরা হলেন- সুজন সরকার (২৮), গজাল ইমন (২৪), ইমন শেখ (২০), সবুজ শেখ (৩০), মিলন শেখ (৩০), দিপু শেখ (২৮), জোবায়ের বিশ্বাস (২৮), সেলিম মোল্লা (৩২), ওসমান মোল্লা (২৬), দিপু সরকার (৩২) ও রসুল ফকির (৪৫)। পুলিশ ইতিমধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
স্থানীয়রা জানান, ভোর ৫টার কিছু পরে মহেশ্বরপাশা খুটিরঘাট এলাকায় ইসমাত জাহান ববির বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলে করে আসে কয়েকজন। মুহূর্তেই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। প্রায় নয় রাউন্ড গুলি চালানোর পর তারা চলে যায়। কিছু সময়ের ব্যবধানে পাশের কার্তিককুল এলাকায় কুয়েটের কর্মচারী মুহাসীন শেখের বাড়িতেও একইভাবে গুলি চালানো হয়।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১৫ রাউন্ড দেশীয় তৈরি শর্টগানের গুলির খোসা ও কিছু ভাঙা জানালার কাচ উদ্ধার করেছে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) সকালে ইসমাত জাহান ববি দৌলতপুর থানায় মামলা (নং-১৪) করেন। মামলায় উল্লেখ আছে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি রাতে তার বাড়িতে হামলা চালায়, গুলি করে ও ভাঙচুর করে ভয়ভীতি সৃষ্টি করে।
মামলায় যাদের নাম রয়েছে তারা সবাই আড়ংঘাটা ও দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই চাঁদাবাজি, হত্যাচেষ্টা ও অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
অন্য মামলাটি (নং-১৩) করেন কুয়েটের কর্মচারী মুহাসীন শেখ। তিনি অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
পুলিশের বিশেষ অভিযানে বুধবার ভোরে আড়ংঘাটা থানার শলুয়া বাজার এলাকা থেকে দুই আসামী—সেলিম মোল্লা ও ওসমান মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দৌলতপুর থানার ওসি (তদন্ত) এ এফ এম জাহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার দুজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। আদালতে তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এই হামলায় জড়িতদের অনেকেই খুলনার আড়ংঘাটা, শলুয়া, রংপুর ও ঘোনা এলাকার পুরোনো চরমপন্থী চক্রের সদস্য। এদের বিরুদ্ধে পূর্বে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আরিফ হত্যা মামলা, চাঁদাবাজি ও মাদক মামলার অভিযোগ ছিল।
দৌলতপুর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, একই চক্রের সদস্যরা আগেও এ এলাকায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এখন তারা নতুন নামে সংগঠিত হচ্ছে।
ডুমুরিয়া ও আড়ংঘাটা থানার সংলগ্ন রংপুর–শলুয়া, ঘোণা ব্রিজ তাজুর বাড়ির পেছন, খালপাড় ও আমভিটা এলাকায় রাত নামলেই নেমে আসে সন্ত্রাসের ছায়া। এখানেই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুজন সরকার তার সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে বসে আড্ডায়। শহর-সংলগ্ন হলেও জায়গাটা কিছুটা নিরিবিলি—তাই এই জনশূন্য কোণাই হয়ে উঠেছে তাদের অস্ত্র মজুতের আস্তানা আর ভয় দেখানোর ঘাঁটি। স্থানীয়দের ভাষায়, রাত হলে ওদের মোটরসাইকেলের শব্দ মানেই গুলি বা হামলার আতঙ্ক।
এসব এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তারা ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে পড়ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, চাঁদা না দিলে গুলি করে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়। পুলিশ আসে, যায়, কিন্তু ভয়টা থেকে যায়।
ভুক্তভোগী মেহেদী হাসানের স্ত্রী ইসমাত জাহান জানান, আমাদের বাসায় গুলির ঘটনায় মামলা করায় হোয়াটসঅ্যাপে তারা আমাকে ও আমার স্বামীকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। আমরা এখন পুলিশের সহায়তায় নিরাপত্তা চাই।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের আড়ংঘাটা থানা, খুলনা জেলা ডিবি, ডুমুরিয়া থানা পুলিশসহ প্রশাসনের সব স্তরের সক্রিয় তৎপরতা জোরদারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। শুধু গ্রেপ্তার নয়—এই এলাকায় নিয়মিত টহল, গোয়েন্দা নজরদারি ও অস্ত্র চক্রের মূলোৎপাটন প্রয়োজন। তাদের ভাষায়, চরমপন্থীরা এখন রাজনৈতিক প্রভাব আর টাকার জোরে টিকে আছে। প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।
মহেশ্বরপাশার সাম্প্রতিক এই হামলা খুলনা অঞ্চলে পুরোনো অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলোর পুনঃসক্রিয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি—অভিযান চলছে, গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকবে। কিন্তু স্থানীয়দের প্রশ্ন—যদি এসব সন্ত্রাসী আগেই পুলিশের তালিকাভুক্ত হয়, তবে এতদিন গ্রেপ্তার হয়নি কেন?
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন




