খুলনার কয়রায় নৌবাহিনীর পেটি অফিসারের মিথ্যা মামলায় দিশেহারা ভুক্তভোগী পরিবার

সম্প্রতি খুলনা জেলার কয়রা থানায় ২টি মামলা রুজু করেছেন বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের কয়রা স্টেশনের পেটি অফিসার কন্টিনজেন্ট কমান্ডার জনাব কায়সার আহমেদ, সরকারি সংখ্যা-৯৪০৬৩৫, জাতীয় পরিচিত নং-৪১৫৯১৮৭৮৫৭।

কয়রা থানায় গত ১৩ অক্টোবর (মঙ্গলবার) রুজুকৃত মামলা নং- ০৯/২০২৫, যার ধারা নং- ৩৯৯/ ৪০২ পেনাল কোড-১৮৬০ তৎসহ ১৯এ দ্যা আর্মস অ্যাক্ট ১৮৭৮ এবং অপর মামলা নং- ১০/২০২৫, যার ধারা নং- ১৪৩/ ৩৩২/ ৩৫৩/৩৪ পেনাল কোড ১৮৬০।

ডাকাতি ও অস্ত্র এবং সরকারি কাজে বাধা প্রদানের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে খুলনা জেলার কয়রা থানার সদর ইউনিয়নের ২নং কয়রা মধ্যবিল গ্রামের রুহুলউল্লাহ ঢালীর ছেলে মো: মহিবুল্লাহ ঢালী (২৭) নামে এক ব্যক্তিকে।

ঘটনার অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১২ অক্টোবর (সোমবার) বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে জনাব মহিবুল্লাহ ঢালী তার পিতা- রুহুল্লাহ ঢালী এবং ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে অচল হয়ে পড়া নদীতে মাছ ধরার বোর্টের ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ২নং কয়রা কাশিখালের গোড়ায় নদীর উত্তর পাশে বাঁধা বোর্টে যান।

ইঞ্জিন মেরামত করাকালীন হঠাৎ পার্শ্ববর্তী লোকজন ডাকাত ডাকাত হাঁকডাক শুরু করে। মানুষের হাঁকডাকে মহিবুল্লাহ ঢালী সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে যায় এবং পার্শ্ববর্তী সোহরাব শেখ (৫২), পিতা- মৃত নেছার শেখ এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পান একজন ভদ্রলোককে বেঁধে রেখেছে সোহরাব শেখ সহ তার আত্মীয় স্বজন।

এক পর্যায়ে মহিবুল্লাহ ঢালী ওই ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানতে পারেন- তিনি নৌবাহিনীর একজন গোয়েন্দা অফিসার (এফআইএস) সরকারি সংখ্যা-২০১৯১০৮৪, নাম- সাজাদ্দুল ইসলাম সৈকত। তিনি আসামি ধরতে এসে মারপিটের শিকার হয়েছেন।

পরবর্তীতে মহিবুল্লাহ ঢালী ওই নৌবাহিনীর অফিসারকে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মোবাইল কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সোহরাব শেখের আত্মীয়স্বজন তার ওপর চোখ রাঙানি শুরু করে এবং পরে মহিবুল্লাহ ঢালী ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়।

এরপর নৌবাহিনী সহ প্রশাসনের বিভিন্ন লোককে ওই সময়ে ভুক্তভোগীর অবস্থান ও যাতায়াতের তথ্য দিয়ে সহায়তা করে মহিবুল্লাহ। এক পর্যায়ে নৌবাহিনীর পেটি অফিসার কন্টিনজেন্ট কমান্ডার জনাব কায়সার আহমেদ সহ তাদের অধীনস্থরা মহিবুল্লাহ ঢালীর ভিডিও বক্তব্য রেকর্ড করেন। ইতোমধ্যে গত ১৪ অক্টোবর (বুধবার) মহিবুল্লাহ ঢালীকে ধরতে ধর-পাকড় শুরু করে প্রশাসন। এতে দিশেহারা হয়ে পড়ে মহিবুল্লাহ সহ তার পরিবার৷

কয়রা থানায় রুজুকৃত মামলা নং-১০/২০২৫ এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ অক্টোবর (সোমবার) দুপুর ২টায় মহিবুল্লাহ ঢালী নৌবাহিনীর অফিসারদের সরকারি কাজে বাধা প্রদান করেন। অথচ বেলা ২টায় মহিবুল্লাহ ঢালী বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। অথচ সরকারি কাজে বাধা প্রদানের মিথ্যা অভিযোগ এনে মহিবুল্লাহ ঢালীকে এই মামলার এজাহারে ৬নং আসামি করা হয়েছে।

এদিকে কয়রা থানায় রুজুকৃত মামলা নং-৯/২০২৫ এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর (মঙ্গলবার) মহিবুল্লাহ ঢালী কয়রা থানাধীন ৭নং দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের রায় নদী হতে খাসিটানা খাল সংলগ্ন সুন্দরবনের মধ্যে এই মামলায় অন্যান্য আসামিদের সাথে সকাল শোয়া ৯টা থেকে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

অথচ ১২ অক্টোবর দিবাগত রাতে ১৩ অক্টোবর প্রথম প্রহরে রাত ২টা হতে ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে কয়রা সদর ইউনিয়নের ২নং কয়রার কাশী খালের গোড়া সংলগ্ন নদীর উত্তর পাড়ে চরে মহিবুল্লাহ ঢালী, তার ছোট ভাই আবু হানিফা এবং তাদের পিতা- রুহুলউল্লাহ ঢালী নদীতে মাছ ধরিতেছিলেন।

১৩ অক্টোবর ভোরে আনুমানিক ৬টায় তারা দক্ষিণ বেদকাশী ফুলতলা সংলগ্ন ৪ রাস্তার মোড়ে মাছ বিক্রি করে এবং মাছ বিক্রি করাকালীন নৌবাহিনীর অফিসারদের গাড়ির বহর সদর ইউনিয়নের দিকে আসতে দেখেন মহিবুল্লাহ ঢালী।

ঠিক এরপরে তারা মাছ বিক্রি করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং সকাল আনুমানিক পৌনে ১০টায় তাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১ কি.মি দূরে কাশিখালের গোড়ায় নদীর ধারে উত্তর পাশে নৌকা ভিড়ায় এবং পরে তারা বাড়িতে চলে আসে।

উল্লেখযোগ্য যে, ১২ অক্টোবর দিবাগত রাত হতে ১৩ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত মহিবুল্লাহর মা- জহুরা খাতুনের (৪৯) নামে রেজিস্ট্রিকৃত ব্যবহৃত মোবাইলের সিম 01980054514 নম্বরটি মহিবুল্লাহ ঢালীর সাথে ছিলো। কিন্তু মামলার এজাহারে তাকে ৬নং আসামি করা হয়েছে। অথচ তিনি ওই সময়ে সংগঠিত অপরাধের স্থানে ছিলো না এবং এই অপরাধের সাথে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নয় এমনটাই অনুসন্ধানে ফুটে উঠেছে। যা মোবাইলের সিম লোকেশন ট্র্যাকিং করলে জানা যাবে।

এদিকে ভুক্তভোগী মহিবুল্লাহ ঢালীর স্ত্রী ফারজানা আক্তার সাথী বলেন, আমার স্বামীকে ডাকাতি ও অস্ত্র মামলায় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আসামি করা হয়েছে। আমার স্বামী একজন জেলে শ্রমিক। ওই দিন নৌবাহিনীর অফিসারকে মারপিটের সাথে সে জড়িত নয় এবং যেভাবে ডাকাতি ও অস্ত্র ও সরকারি কাজে বাধা প্রদানের মামলা রুজু করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক। এই বিষয়ে নৌবাহিনীসহ পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহায়তা কামনা করছি। নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি বন্ধ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপও চান মহিবুল্লাহর স্ত্রী।

এদিকে মামলার বাদী নৌবাহিনীর কয়রা স্টেশনের পেটি অফিসার জনাব কায়সার আহমেদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মহিবুল্লাহ ঢালী যদিও আমাদের লোকজনকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু তার ভিডিও বক্তব্যে সন্দেহজনক আচরণ প্রকাশ পেয়েছে এবং আমার অফিসারদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে। তাই তাকে মামলার এজাহারে আসামি করা হয়েছে।

এমন যুক্তির তীব্র সমালোচনা করে সুশীল সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভিডিও বক্তব্য প্রদানে অভ্যস্ত নয়, এমন মানুষের ভিডিও বক্তব্য নিয়ে ডাকাতি ও অস্ত্র এবং সরকারি কাজে বাধা প্রদানের মামলার এজাহারে আসামি করা নিতান্ত হয়রানিমূলক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এবিষয়ে যথাযথ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন তারা।

সদর ইউনিয়নের মোশাররফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, মহিবুল্লাহ ঢালী এসকল কাজের সাথে জড়িত নয়। তাকে ডাকাতি ও অস্ত্র মামলায় যেভাবে আসামি করা হয়েছে। তা সবাইকে অবাক করেছে। আর ঘটনার দিন মহিবুল্লাহ ঢালী প্রশাসনকে নানাবিধ তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। অথচ তাকে হয়রানি করতে এ মামলা দেওয়া হয়েছে। এভাবে কয়রায় নিরপরাধ মানুষ মামলার আসামি হলে, অদূর ভবিষ্যতে প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা উঠে যাবে।

এবিষয়ে কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব মো: মোতালেব হোসেন বলেন, মামলাটির জন্য আবেদন করেছেন বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের একজন অফিসার। আমরা শুধু মামলাটি রেকর্ড করেছি। কে অপরাধের সাথে জড়িত, আর কে অপরাধে জড়িত নয়, তা তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত হবে। মামলায় কেন মহিবুল্লাহর নাম দেওয়া হলো- এবিষয়ে নৌবাহিনীর ওই অফিসারের সাথে যোগাযোগ করেন।