গত পাঁচ বছরে যেসব সংকটের মুখোমুখি হয়েছে সরকার
টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ তাদের জোটভুক্ত দলগুলো নিয়ে সরকার গঠন ও দায়িত্ব পালন করেছে৷ এ সময় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে তাদের৷ বিগত পাঁচ বছরের সংকটগুলো কীভাবে তারা মোকাবেলা করেছে?
ডয়চে ভেলে বাংলা সম্প্রতি দৈব চয়ন পদ্ধতিতে কয়েকজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে৷ বর্তমান সরকারের ভালোমন্দ সম্পর্কে তাদের ভাবনা জানার চেষ্টা করেছে৷ এঁরা ছিলেন বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ৷ তবে যে বৈশিষ্ট্যটি সবার মধ্যেই বিরাজমান ছিল, তা হলো এরা সবাই ভোটার৷
কী দেখা গেল?
দেখা গেল যাঁরা পক্ষে বলছেন, তাঁরা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ করে পদ্মা সেতু তৈরি, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ে উন্নীত করা, জঙ্গিবাদ দমন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া, এ সব বিষয় তুলে ধরেছেন৷
যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা কিছু নেতা-কর্মীর অপকর্ম, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন৷
এই মানুষগুলোর কথায় মূলত সরকারের চলতি মেয়াদের চ্যালেঞ্জগুলোর কথাই উঠে এসেছে, যার কোনো কোনোটি সংকটের আকার ধারণ করেছিল বা এখনো করে আছে৷ এগুলো সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে গেছে, সরকার কীভাবে তার মোকাবেলা করেছে, তার ওপর৷ যেসব সংকট সরকার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে, বা প্রশ্রয় দিয়েছে, সেগুলোতে সমালোচনা এসেছে৷ যেগুলো মোকাবেলা করতে পেরেছে, সেগুলো জনগণ সাদা চোখে ইতিবাচক হিসেবেই দেখেছে৷
জঙ্গিবাদ
দেশের অভ্যন্তরে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জঙ্গিবাদ৷ একের পর এক ব্লগার ও মুক্তমনাদের হত্যার পর যখন ২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটে, তখন সেটি অনেক বড় সংকট ছিল সরকারের কাছে৷ এই হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারান ১৭ জন বিদেশি ও তিনজন বাংলাদেশি৷ এছাড়া জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান দুই পুলিশ সদস্য৷ পরে হামলাকারী ছয়জনও নিহত হন৷
এতজন বিদেশি নিহত হবার পর রীতিমত নাগরিকদের ওপর বাংলাদেশে ভ্রমণ অ্যালার্ট জারি করে বেশ কয়েকটি দেশ৷ বিদেশি অনেক পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশকে ইসলামি উগ্রবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বা সেই পথে এগুচ্ছে বলেও লেখা প্রকাশিত হয়৷ মোট কথা, দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে৷ এ অবস্থা থেকে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়ে শুধু সেই পরিস্থিতিই সামাল দেয়নি, বরং পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি অভিযান চলে দেশজুড়ে৷ পেছন ফিরে দেখলে, এভাবে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি যথেষ্ট সফলতার সঙ্গেই সামাল দিয়েছে তারা৷ তবে জঙ্গিবাদ একেবারে নির্মূল করা গেছে, এমনটা দাবি করা যাবে না৷
রোহিঙ্গা
সংকটটি বাইরে থেকে এসেছে৷ কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী৷ এই সংকটে সরকার মানবিকতা দেখিয়ে নতুন করে আরো সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে৷ তা সারা বিশ্বের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে৷ কিন্তু যাদের কারণে এই সংকট সেই মিয়ানমার এর দায়ভার নিতে চাইছে না৷ বরং বার বার ইতিহাসের দায় ঠেলে দিতে চাইছে বাংলাদেশের দিকেই৷ একইসঙ্গে পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদেও তারা ‘বাইরের ইন্ধন’ দেখছে৷
এই সংকট বাংলাদেশের মাথার ওপর বিরাট সংকট৷ যেখানে জার্মানির মতো ধনী দেশও হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে, দশ লাখ শরণার্থী নিয়ে, সরকারের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, সেখানে সমান সংখ্যক বা তার বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের সরকার জনগণেরও সমর্থন পেয়েছে৷ তবে বহির্বিশ্বের আচরণ এখন পর্যন্ত মৌখিক পর্যায়েই আছে৷ তারা মিয়ানমারের ওপর কার্যত তাদের সেনাবাহিনীর ওপর কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারেনি৷ বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত এক্ষেত্রে সহনশীলতা ও ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে৷ তবে দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট নিয়ে ভূগতে হবে, তা নিশ্চিত৷
তারুণ্যের ক্ষোভ
বাংলাদেশে এখন সিংহভাগ জনগোষ্ঠী তরুণ৷ এই তারুণ্যের একটা অংশের ক্ষোভ দেখা গেছে সরকারের ওপর৷ প্রথমত, কোটাবিরোধী আন্দোলন ও পরে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে এই কিশোর তরুণরা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন৷ এই ক্ষোভ সামলাতে সরকার বল প্রয়োগ করেছে৷ সরকারি দলের সহযোগী ছাত্র ও যুব সংগঠনের বিরুদ্ধেও এই তরুণদের দমন পীড়নের অভিযোগ উঠেছে৷
নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের ওপর কেন হামলা করা হয়েছে, তার জবাব পরিষ্কার নয়৷ আপাত দৃষ্টিতে সরকার এ সব আন্দোলন দমাতে পারলেও এই অসন্তোষ দমাতে পারেনি৷ দীর্ঘমেয়াদে তাদের সমস্যার মূলে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ অন্তত সমাধানের পথে হাটছে, তেমনটি পরিষ্কারভাবে দেখাতে হবে, যা করতে এই সরকার ব্যর্থ হয়েছে৷
প্রশ্নপত্র ফাঁস
প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়া ঠেকানো এই সরকারের জন্য একটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল৷ এগুলো সামাল দিতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যারপরনাই হিমসিম খেতে হচ্ছিল৷ শেষ পর্যন্ত ফাঁস ঠেকানো গেছে বলে সরকার দাবি করলেও সংশয় একেবারে কেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে না৷
ব্যাংক খাতে দূর্নীতি
গত পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতে চরম অস্থিরতা দেখা গেছে৷ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে লুটপাটের যে চিত্র দেখা গেছে, তা রীতিমত ভীতিকর৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে, সে প্রশ্নই শুধু ওঠেনি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা রীতিমত বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে৷
রিজার্ভ ফেরত আনার বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে৷
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা কম হয়, এমন একটি ধারণা সবসময়ই আছে৷ কিন্তু চলতি আমলেই বেশ কিছু ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে৷ ফেসবুকে মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে এরপর হামলা করার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷ শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ই নয়, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা হয়েছে৷ অনেক এলাকায় এসব হামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকেরা জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে৷ এগুলোও সামাল দেয়াও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল৷
এর বাইরেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে নানা সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে বর্তমান সরকারকে৷ যখন যে সরকার থাকে, সে সরকারকে করতে হয়৷ কিছু কিছু সংকট ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে৷ কিছু কিছু নতুন করে সামনে এসে পড়ে৷ বিষয় হলো, সবকিছুকে সাদা-কালো হিসেবে দেখার সুযোগ নেই৷-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন