গালি || নাজমীন মর্তুজা
গালি শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এই গালি শব্দটি বলতে আসলে সেই সব শব্দ কে বোঝায় যা অন্যের প্রতি ব্যবহার করলে তাকে আহত, পীড়িত এবং লজ্জিত করে অন্তত মানসিক ভাবে । আর এই ‘গালি’ শব্দটির মধ্যে অনেক সময় থাকতে পারে প্রচ্ছন্ন ভাবে হননেচ্ছা, ঘাতেচ্ছা, ধর্ষণেচ্ছা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসলে আমরা কি জানি কেন মানুষের মধ্যে এমন গূড় ইচ্ছার উদ্ভব হয়, বা এর কারণ টা কি ?
এসব উত্তর সচরাচর সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীরাই দিয়ে থাকেন। একদল সমাজ বিজ্ঞানীর মতে নাকি “ ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের সঙ্গে এই সব গূড় বা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছার কিছু না কিছু যোগ থাকে ।
মানুষের অবচেতন মনের এমন সব ইচ্ছা সামাজিক বিধি নিষেধের দ্বারা অবদমিত থাকে।
ইচ্ছার অবদমনকে বলা হয় inhibition। তবে এই অবদমন অনেক সময় মানুষের মানসিক স্বাভাবিকতাকে পঙ্গু করে দিতে পারে । মানসিক ভারসাম্য কে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে । মনোবিজ্ঞানীরা তাই বলে থাকেন । কিছু কিছু মানুষ এই অবদমন থেকে মুক্তি খোঁজে। প্রথমত স্বপ্নের মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত নানা ব্যক্তিগত সমষ্টিগত অপরাধ মূলক কাজকর্মের (যেমন চুরি ডাকাতি ছিনতাই হত্যা কিংবা ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা, ইত্যাদি) মধ্য দিয়ে এবং তৃতীয়ত গালি বা টিটকার রীযুক্ত শব্দ প্রয়োগের দ্বারা ।
এরা এটাও মনে করেন যে গালির মধ্য দিয়ে মানুষ দুই ধরনে র অবদমন থেকে মুক্তি খোঁজেন।
নারী, নারী দেহ এবং যৌন সংযোগ সম্পর্কিত বিধি নিষেধ লঙ্ঘন, আঘাত বা হত্যা সম্বন্ধে বিধি নিষেধ লঙ্ঘন হচ্ছে অবদমন থেকে মুক্তি খোঁজার পথ। একটা রকম ফের। কাউকে গালি দিয়ে বা কোন মেয়েকে টিটকারী করে অবচেতন মনের অবদমিত ইচ্ছা পূরণের তৃপ্তি সাধন হয়ে থাকে।
তবে এটাও ঠিক যে সব মানুষ গালি দেয় না। সারা জীবনে গালি দেয়নি এমন মানুষ আছে কিনা কে জানে? এক্ষেত্রে দেখেছি মা-ছেলের সাথে গালি ব্যবহার করেই কথা বলেন, আবার টেম্পু-বাসের হেল্পার, কন্টাক্টার, ড্রাইভার এমনকি -রিক্সা-ঠেলাগাড়ি-ভ্যানচালকরা পরস্পর গালি দিয়ে পরস্পরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। মেথর ও হরিজনদের জীবনে গালিই কখনো কখনো দৈনন্দিন ভাষা! তবে, গালি কখনও কখনও পারস্পারিক যোগাযোগের ভাষাও বটে। ঢাকার ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের অনেকে গালিকে ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে।
কেউ যখন কাউকে ‘শালা’ বলে সেটা কিন্তু গালি বলে গণ্য হয়। এই শব্দের মধ্যে কিন্তু ব্যক্তির বোনের সঙ্গে একটা অবৈধ সংসর্গের ইঙ্গিত থাকে। ঠিক একই কারণে কিন্তু ‘মামা’ শব্দের মধ্যেও গালির আভাস থাকে । আমরা যারা গ্রামের জীবন দেখে এসেছি তারা কমবেশী সকলেই জানি মহিলাদের মুখে মুখে অভিসম্পাত করে গালি দেয়া যেমন “ওলাওঠে মরবি , জহরে কহরে মরবি (বিষ খেয়ে নতুবা পিপাসায় ), তোর কলেরা হবে, অলপ্পেয়ে (স্বল্প আয়ু হোক ) তোর খাল আমি ভরবো (কবর খোরা) এমন সব গালি শোনা যায় যা থেকে হননেচ্ছার ইঙ্গিত থাকে।
আর পুরুষদের মধ্যে কিছু গালি দিতে শুনি যেমন সে গুলোতে সচরাচর ধর্ষণ এবং সমকামিতা অবৈধ সংসর্গ নানা ধরনের যেমন – মাতৃকাম, ভগ্নিকাম, কলা কাচকলা যা পুরুষাঙ্গের প্রতীক, গালি হিসেবে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখানো একই ব্যপার।
এমন গালি অসংস্কৃত নিরক্ষর মহিলার মুখেও শোনা যায় – ভাইভাতারী, বাপভাতারী এই সব শব্দ গুলো স্পষ্টই অজাচারের ইঙ্গিত বহন করে।
এছাড়াও গালি হিসেবে পশুর নামের মধ্যেও অবৈধ সংসর্গের আভাস থাকে, পশুর সঙ্গে মানুষের যৌনতার ইঙ্গিত। যেমন কুকুরের বাচ্চা, শুকোরের বাচ্চা এসব শব্দ চরম অপমানকর ও অশ্লীল।
তবে গালির শব্দ ব্যবহারে স্ত্রী পুরুষের মধ্যে ভেদ আছে তা স্থানিক ও সাংস্কৃতিক গত ভেদ।
আমরা সাধারণত জানি যে নিষিদ্ধ শব্দ হচ্ছে বয়স্ক মানুষের ব্যপার যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের গালির ভাণ্ডার ও বাড়তে থাকে। তাই তো দেখি দাদী নানী দাদু দের মুখে টিটকারী ছলে অকথ্য শব্দ ব্যবহার।
তবে হ্যাঁ এটাও সত্যি যে গালি শব্দ ব্যবহারের প্রতি মানুষের আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হচ্ছে গালির ঝোঁক। বহুদিন আগে একটা গালির অডিও ভাইরাল হয়েছিল সে যে কত ধরনের গালি তা বলবার মত শব্দ আমার জানা নাই, শুধু থ বনে গিয়েছিলাম একবার শুনেই । আমার মনে হয় বাংলাভাষার গালি শব্দগুলোর ব্যপক সংগ্রহ বিজ্ঞান সম্মত ভাবে যদি করা হয়, তবে গালি শব্দের ব্যবহার গত প্রভেদ যেমন গ্রামীন, শিক্ষা, ধর্মগত, বয়স, লিঙ্গ, সামাজিক , সাংস্কৃতিক স্তর গুলোর ভেদ রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। আমার জানা নেই বাংলাভাষায় গালি নিয়ে ফোকলোর গবেষক রা কাজ করেছেন কি না বা পুস্তক আকারে তা প্রকাশিত হয়েছে কি না, এ ব্যপারে আমার জানা তথ্য খুব কম ।
যে সমাজে শ্রেনী শোষণ অবাধ, পুরুষের আধিপত্য প্রশ্নাতীত – সেই সমাজে গ্রামের নিরক্ষর মেয়েদের মুখে উচ্চারিত গালি শব্দ গুলোতে প্রতিবাদ ক্ষোভ ও হননের ইচ্ছা একটা প্রচ্ছন্ন জায়গা জুড়ে থাকে ।
রবীন্দ্রনাথের সংগৃহিত “ছেলে ভোলানো ছড়ায় ‘ভাতার খাকী’ শব্দটি দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। তেমনি বাংলা সিনেমার গানে গালি শুনেছি “তুমি একটা চোর! এই সব গালির শব্দ গুলো সচরাচর পুত্র কন্যা, প্রিয় পরিজনদের উপর বর্ষিত হয় । আর আমরা বাঙ্গালীরা তো টিটকারীতে পটুই বলা যায়।
গালির শব্দগুলোকে সামাজিক অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্বিক দিক থেকে সুনিপূন ভাবে বিশ্লেষণ করলে বেশ বোঝা যায় যে দরিদ্র নিপীড়িত, সমাজ লাঞ্ছিত, পরিবার পরিজনের হাতে নিগৃহীত অসহায় , নিরুপায় নারী হৃদয়ের হাহাকার কত বাস্তব ও মর্মান্তিক।
লেখক :
নাজমীন মর্তুজা
অ্যাডেলএইড, সাউথ অষ্ট্রেলিয়া
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন