গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের, চালকদের মারধর

রাজধানীতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কবির হোসেন শ্যামলী পরিবহনের একটি গাড়িতে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কামারপাড়া পয়েন্টে এলেই উত্তেজিত শ্রমিকরা গাড়ি থেকে সব যাত্রীকে নামিয়ে দেন। পরে হাতে বড় লাগেজ নিয়ে হেঁটে হেঁটেই গন্তব্যে রওনা দেন তিনি।

তিনি বলেন, গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার পর সিএনজি কিংবা রিকশা খুঁজছিলাম। কিন্তু তাও পাওয়া যাচ্ছে না।

শ্রমিকদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটে রোববার গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বিকল্প উপায়েও যাত্রীদের গন্তব্যে যেতে বাধা দিচ্ছেন শ্রমিকরা। এতে দিনের শুরুতেই ভোগান্তিতে পড়েন কবির হোসেনের মতো জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হওয়া মানুষ।

গাড়ি নিয়ে বের হলে কোথাও কোথাও চালক ও তাদের সহকারীদের মারধরও করা হয়েছে।

কামারপাড়ার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মজিবুর রহমান বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ বাধা দিচ্ছে না, রাস্তার শৃঙ্খলা রক্ষায় বিপুল পুলিশ অবস্থান করছেন।

আট দফা দাবিতে পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে সারা দেশে বাস ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

রাজধানী উত্তরার ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা আশুলিয়া মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে অবস্থান করছেন শ্রমিকরা। তারা কোনো গাড়ি আসতে কিংবা যেতে দিচ্ছে না। রাস্তায় গণপরিবহন একেবারেই নেই। তবে কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে।

শ্রমিকরা বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি(তদন্ত) আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমরা রাস্তায় অবস্থান করছি, শ্রমিকরা যাতে বিশৃঙ্খলা করতে না পারেন, সে জন্য সতর্ক রয়েছি। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি যাতে ভাঙচুর করতে না পারে।

রোববার সকাল থেকে রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলো থেকে কোনো গন্তব্যের বাস ছেড়ে যায়নি। বন্ধ রয়েছে শহর এলাকার বিভিন্ন রুটের বাস।

পরিবহন শ্রমিক নেতারা এ ধর্মঘটকে কর্মবিরতি বললেও পরিবহন শ্রমিকরা মোড়ে অবস্থান নিয়ে অন্য যানবাহন চলাচলে বাধা দিচ্ছেন। দুয়েকটি অটোরিকশা চললেও তা থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছেন।

প্রধান সড়কগুলোতে কিছু রিকশা চলাচল করলেও অফিসগামী যাত্রী আর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যানবাহনের আশায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে প্রতিটি মোড়ে। অনেকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।

সকালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ব্যক্তিগত গাড়ি আর রিকশা ছাড়া আর কোনো যানবাহন চোখে পড়েনি। বিআরটিসির বিভিন্ন ডিপো থেকে বাস চালানোর চেষ্টা করা হলেও পরিবহন শ্রমিকদের বাধায় চালানো যাচ্ছে না।

শুধু বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী পরিবহনের বাস রাস্তায় দেখা গেছে।

বিআরটিসির গাজীপুর ডিপোর ম্যানেজার বুলবুল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সকালে আমি কিছু বাস বের করেছিলাম। কিন্তু গাজীপুর চৌরাস্তা ও বোর্ডবাজারে সেগুলো আটকে দিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। আমাদের কয়েকজন চালককে পিটিয়েছে। এ জন্য এখন বাস চালানো বন্ধ আছে।

গাবতলী ডিপোর ব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, মিরপুর ১০ নম্বরসহ কয়েক জায়গায় বাস আটকে দেয়া হয়েছে। সেগুলো সেখানেই আছে। আমিও প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মিরপুর ১০ নম্বরে বসে আছি। পরিবহন শ্রমিকরা কোনো গাড়ি যেতে দিচ্ছে না। কামারপাড়া থেকে মতিঝিল যাওয়ার বাস আবদুল্লাহপুরে আটকে দেয়া হয়েছে।

বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক জানান, মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে সকালে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পরিস্থিতিও একই রকম বলে জানিয়েছেন সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম।

তিনি বলেন, কোনো বাস যাচ্ছে না আসছেও না। সব কিছু বন্ধ। আমরা তো গাড়ি চালাতে চাই। কিন্তু শ্রমিকরা না চালালে কি করি? এর একটি সমাধান দরকার, সে জন্য আলোচনা দরকার।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় লোকজনকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কিছু হিউম্যান হলার, ইজি বাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় স্বল্প দূরত্বে যাতায়াত করছেন লোকজন।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীতে বাসচাপায় দুই স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা সড়ক পরিবহন আইন পাস করে।

কিন্তু ওই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সেগুলো বাতিল করার দাবি তুলেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

তাদের দাবিগুলো হল- সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা, ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ এবং গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা।

এর মধ্যে জামিন অযোগ্য ধারা বাতিল করে জামিনযোগ্য করা শ্রমিকদের মূল দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, দুর্ঘটনা জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় এমন নজির কোথাও নেই। এ ছাড়া দুর্ঘটনার জন্য চালকের পক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা দেয়া সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রুস্তম আলী বলেন, শ্রমিকদের দাবির সঙ্গে আমরা একমত। এ জন্য এই কর্মসূচিতে আমাদের সমর্থন আছে। একজন শ্রমিককে যদি পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়, তা হলে সে কেন গাড়ি চালাতে আসবে। সে তো অন্য ব্যবসা করতে পারে।