গুপ্ত মানব || আকিদুল ইসলাম সাদী
(পূর্ব প্রকাশের পর….)
কণা আহমাদ রায়হান রেজার সাথে কথা শেষ করে প্রাইভেট পড়তে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো প্রাইভেটের অন্যান্য সব ছাত্র-ছাত্রীরা চলে এসেছে। শুধু কণাই বাকি ছিলো। আজ তার আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। কণা তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের এক পাশে বসে পড়লো। ম্যাডাম শবনাম সাদিকার দৃষ্টি থেকে বিষয়টা এড়ালো না। সে ওদেরকে দু’বেলা পড়ায়। সকাল আর বিকেলে। কণা প্রতিদিন দু’বেলাই সবার আগে পড়তে আসে কিন্তু আজ দেরি। এর কারণটা কী! বিষয়টা জানার খুবই আগ্রহ জাগলো তার মনে। কণা কোন সমস্যায় পড়লো কী-না সেটিও ভাবনায় এলো। তাই বিষয়টা খুল্লামখুলুমভাবে জানার চেষ্টা করলো শবনাম সাদিকা।
– কণা দাঁড়াও!
তার আদেশ পেয়ে কণা বাধ্য মেয়ের মতো কোন কথা না বলেই দাঁড়িয়ে গেলো।
– তুমি আজ এতো দেরি করলে কেনো? তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?
– না আফা, কোন সমস্যা হয় নি।
– তাহলে দেরি কেনো?
– একটা লোকের সাথে কথা কইতে কইতে দেরি হইয়া গেছে।
– লোক, কে সে লোকটা? (আশ্চর্য কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।)
– চিনি না আফা! তবে হে কইলো, তার বাড়ি নাকি ঢাহা!
ঢাকার কথা শুনে শবনাম সাদিকা অবাক হয়ে গেলো। এই গাঁও-গ্রামে ঢাকার লোক কোথা থেকে এলো? বিষয়টা খুবই আশ্চর্যের! ইতিপূর্বে কখনো সে ঢাকার লোক দেখেনি। কৌতুহোল জাগলো লোকটিকে দেখার। ঢাকার লোকেরা নাকি অসম্ভব সুন্দর হয়! চালাকও কম নয়। তবে গ্রামের মানুষদের সাথে চালাকি করে পেরে ওঠে না। তাদের বচনভঙ্গীও নাকি চমৎকার হয়! এমন অনেক ভাবনা উদয় হলো শবনাম সাদিকার অন্তরাকাশে। অতঃপর সে কণাকে বসতে বলে পড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করলো।
আজ পড়ানোর মধ্যে তার মন তেমন বসছে না। বারবার শুধু ঢাকা থেকে আসা লোকটির কথা মনে উঠছে। দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে। ফলে বেশিক্ষণ পড়ানো হলো না তার। সবাইকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিলো। শুধু কণাকে বললো একটু লেট করে যেতে। কণা তার কথায় থেকে গেলো। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই চলে গেলে শবনাম সাদিকা তার রুমে নিয়ে কণাকে বসতে দিলো। এরপর আরেক রুমে গিয়ে কণার জন্য হালকা কিছু নাস্তা আনলো। তাকে খেতে বলে শবনাম সাদিকা গল্প শুরু করলো। একপর্যায় সে কথার ফাঁকে ঢাকা থেকে আগত লোকটির কথা উঠালো। জানতে চাইলো লোকটি দেখতে কেমন, এই এলাকায় সে কেনো এসেছে? তার কি কোন আত্মীয়-স্বজন আছে কি-না এই এলাকায়? এমন আরো অনেক কিছু। কণা তার কথাগুলোর ঠিক ঠিকভাবে উত্তর দিলো। অবশেষে শবনাম সাদিকা বললো, জানো কণা! আমার না ঢাকার লোক দেখার ভীষণ সখ! কখনো দেখি নি তো, তাই!
– আফা তাইলে ওনারে একদিন আপনাগো বাড়িতে নিয়ে আইবো?
– কিভাবে? যদি কিছু মনে করে?
– কিছু মনে কোরবো কেন?
– আমি তাকে আসতে বলেছি, এটা কেমন দেখায় না? তাই আরকি!
– আমি বলুম নাকি যে আপনে আসতে কইছেন?
– তাহলে কী বলে আনবে?
– আমি বলুম যে, চলেন আমাগো পেরাইভেটে যাই!
– এই বললেই কি উনি আসবেন?
– উনি আমারে বন্ধু বানায়ছে। কইছে, আমার সাথে নাকি এই এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখবো। সুতরাং আমার মনে হয় আমি কইলে আইবো!
– আচ্ছা দেখো আনতে পারো কি-না! আনতে পারলে তো আমি অনেক খুশি হবো।
– আচ্ছা দেহি তাইলে কী করন যায়।
অতঃপর তাদের দুজনের কথার সমাপ্তি ঘটলো। কণা রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আহমাদ রায়হান রেজা বেদেদের কথা অনেক শুনেছে। তাদের জীবনী নিয়ে গল্পও পড়েছে অনেক। ভাগ্যক্রমে এখন সে বেদেপল্লীর পাশেই থাকে। মাঝে মাঝেই সেখানে ঘুরতে যায়। তার সাথে থাকে ছোট্ট বন্ধু কণা। দু’জনে গল্প করে আর ঘুরে বেড়ায়। আহমাদ রায়হান রেজা কণাকে শুনায় ঢাকার শহরের বিভিন্ন গল্প, যা শুনে সে খুবই আনন্দিত হয়। কণাদের বাড়িতেও সে কয়েকবার গিয়েছে। যারফলে কণাদের ফ্যামেলীর সাথে অল্প দিনেই গড়ে উঠেছে তার খুব ভালো সম্পর্ক। কণাদের বাড়ির লোকেরা তাকে খুবই সম্মান করে।
আহমাদ রায়হান রেজা কাজ থেকে আজ কিছুটা অবসর হলো। সুতরাং এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সে ঘুরতে বের হবে। তার সাথে থাকবে কণা। সেজন্য আগে সে কণাদের বাড়িতে গেলো। অতঃপর তাকে নিয়ে ঘুরার জন্য বের হলো। কণা কথায় কথায় বলে ফেললো, বন্ধু আজ আপনেরে নতুন এক জাগা নিয়ে যাইমু, তা যাইবেনতো?
– আমার ছোট্ট বন্ধু নতুন জায়গা ঘুরাতে নিয়ে যাবে আর আমি যাবো না, এটা কি হয়? তবে বন্ধু কোথায় নিয়ে যাবে আগে বলো না শুনি! খুবই ইচ্ছে করছে শুনতে!
– আমি যেইখানে পেরাইভেট পড়ি সেইখানে!
– তাই নাকি?
– হ!
– তাহলে তো ভালোই হবে। আমি দেখে আসবো আমার বন্ধু কেমন জায়গা প্রাইভেট পড়ে। কিন্তু ……!
– কিন্তু কী?
– তোমাদের প্রাইভেট ম্যাডাম কিছু মনে করবে না?
– না, আফা আরও খুশি হইবো!
– তাই!
– হ!
– ঠিক আছে, তাহলে চলো।
কণা আহমাদ রায়হান রেজাকে শবনাম সাদিকাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে নিয়ে রওনা হলো। যাওয়ার পথে সে আহমাদ রায়হান রেজাকে তাদের স্কুল দেখালো। আরও দেখালো বেদেদের কিছু বিস্ময়কর জিনিস। এভাবে একসময় তারা পৌঁছে গেলো শবনাম সাদিকাদের বাড়িতে। কণা আফা আফা বলে ডাক দিলে শবনাম সাদিকা ঘর থেকে বের হয়ে এলো। এসে দেখতে পেলো কণার সাথে অপরিচিত একজন লোক। দেখতে খুবই সুন্দর! মুখে দাড়ি থাকলেও, বেশ হৃষ্টপুষ্ট কম বয়সী। চোখটা তার মাটির দিকে নামানো। মনে মনে সে ভাবলো, নিশ্চয় ইনিই ঢাকার সেই লোক। তবে এতোটা লাজুক কেনো? শুনাতো যায়, ঢাকার লোকদের একটু লজ্জা কম হয়। তারা সবসময় ছেলেমেয়ে উভয়ের সাথেই ইজি থাকে। না অন্য কোন লোক? এমন আরও অনেক কিছু ভাবতে লাগলো শবনাম সাদিকা। তাদেরকে বসতে বলার কথাও সে একদম ভুলে গেলো। এমতাবস্থায় কণা বললো, আফা ইনিই হলেন আমার সেই ঢাহার বন্ধু, যার কথা আপনারে কইছিলাম! কণার কথায় ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো শবনাম সাদিকা। সামান্য লজ্জিত মুখে সে বললো, ও তাই নাকি? আসুন, ভেতরে আসুন। কণা এবং আহমাদ রায়হান রেজা ভেতরে গিয়ে বসলো।
শবনাম সাদিকা তার মা মাহফুজা বেগমকে গিয়ে ঢাকার এই মেহমানের কথা জানালো। তিনি জানালেন শবনাম সাদিকার বাবা হাফিজ সাহেবকে। দুজনেই খুশি খুশি মনে এসে আহমাদ রায়হান রেজার সাথে পরিচিত হলেন। তার অল্প কিছুক্ষণ পরই এলো শবনাম সাদিকা। তার পিছন পিছন নাস্তা নিয়ে এলো তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে। অতঃপর কণা এবং আহমাদ রায়হান রেজাকে নাস্তা করতে বলে গল্প শুরু করলো শবনাম সাদিকার বাবা।
– আপনার বাসা ঢাকা কোন জায়গা?
– গুলশান!
– তা আমাদের এই গৈ-গেরামে কী মনে করে এলন? ঘুরতে নাকি?
– অনেকটা এমনই, সাথে কাজের ধান্দাইও!
– কাজের ধান্দাই মানে?
– মানে কোন কাজের তালাশে!
– বেশ বেশ, তা কোন কাজ কি পেলেন?
– হ্যাঁ পেয়েছি, ছোট-খাটো একটি কাজ।
– আসলে কোন কাজই ছোট নয়, যার যার স্থানে সেই কাজই বড়। তা কী কাজ করছেন?
– পলাশপুর বাজারে একটা হোটেলে ম্যানেজারি!
– বেশ বেশ! তা আমাদের এলাকা ঘুরে কেমন দেখলেন? অর্থাৎ কেমন লাগছে আপনার কাছে?
– অনেক ভালো।
এবার কথা বলা শুরু করলেন শবনাম সাদিকার মা মাহফুজা বেগম।
– তা বাবা আমাদের এলাকায় কতোদিন থাকবা?
তার কথা শুনে শবনাম সাদিকা ও তার বাবা হেসে উঠলো। তা দেখে তিনি বললেন, কী ব্যাপার, তোমরা হাসছো কেনো? শবনাম সাদিকা বললো, মা তুমি প্রথম দেখায়ই ভদ্রলোককে বাবা ডেকে ফেললে? ও তাইতো! কিছু মনে করেন না! আসলে মুরব্বি হয়ে গেছিতো, তাই ইচ্ছে না করলেও এমনটা বের হয়ে যায়।
– আরে না, না। আপনিতো আমার মায়ের মতোই। তাছাড়া আমার মতো তো আপনাদের ছেলেও আছে। এটা কোন ব্যাপার না! এরপর থেকে আশা করবো আপনারা দুজন, মানে কাকাবাবু আর আপনি আমাকে এই শব্দ থেকে বঞ্চিত করবেন না!
– নারে বাবা আমাদের কোন ছেলে নেই। একটাই মাত্র মেয়ে।
– ও তাই!
– হুঁ, তা বাবা তোমাকে যা বলছিলাম, কতোদিন থাকবে এই এলাকায়?
– জানি না, আল্লাহ তায়ালা যতোদিন রিজিক রেখেছেন।
– তাই!
– জি!
এভাবে আরো অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন তাঁরা। আহমাদ রায়হান রেজাও সব কথার উত্তর দিলো। শবনাম সাদিকা মাঝে মাঝে কিছু কথা বললো। অতঃপর তাদের থেকে বিদায় নিলো আহমাদ রায়হান রেজা আর কণা! চলে গেলো তারা যার যার স্থানে। অর্থাৎ কণা চলে গেলো বাড়িতে আর আহমাদ রায়হান রেজা চলে এলো তার ঐ আত্মীয়র বাড়িতে।
শবনাম সাদিকার বাবা হাফিজুর রহমান সাহেব এলাকার একজন নামকরা গৃহস্ত। মাঠভর্তি চাষের জমিন, বাড়িভর্তি দালান-কোটা, আর প্রচুর তার চাকর-কিষাণ। শবনাম সাদিকা প্রাইভেট পড়ায় বিনি টাকায়। গরিবদেরকে সেবা করাই তার উদ্দেশ্য। তার বাবা প্রাইভেট পড়াতে তাকে অনেক নিষেধ করেছেন কিন্তু সে শোনেনি। তাকে আরও অন্য কথা বলে বুঝ দিয়েছে। শবনাম সাদিকা তার বাবাকে বলেছে- বাবা! আজকের শিশু ভবিষ্যতের কর্ণধর। একসময় সমাজ-দেশ থেকে জ্ঞানীরা বিদায় নিবে। সেসব খালি জায়গাগুলো ওদের দ্বারাই অলংকৃত হবে। সুতরাং ওদের লেখাপড়া শেখা খুবই প্রয়োজন। ওরা গরিব, প্রাইভেট পড়ার মতো টাকা-পয়সা নেই। ওদের পিছনে যদি আমি একটু সময় ব্যয় করি, আমার কোন ক্ষতি হবে না। বরং দেশের ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য কিছু করা হবে। তাছাড়া ওদের মধ্যে যদি শিক্ষার আলো না যায়, তাহলে ওরা চোখ থাকতেও অন্ধ থাকবে। শুধু তাই-ই নয়; একসময় সমাজ-দেশের জন্য ভয়ঙ্কার হয়ে দাঁড়াবে। তার এই কথার পর হাফিজ সাহেব আর কোন দ্বি-মত পোষণ করেন নি। তারপর থেকেই শবনাম সাদিকা এই মহৎ কাজে বেশি মনোযোগী হয়েছে। তার কাছে এখন বিভিন্ন শ্রেণীর ছেলে, মেয়েরা পড়ালেখা করে। আজ কণার মতো বেদের মেয়েও পড়ালেখা করতে পারছে তার এই মহৎ কাজের জন্যই। কণার মতো অনেক বেদের মেয়েই তার কাছে বিনা টাকায় প্রাইভেট পড়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে।
(চলবে……)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন