গুমের শিকার পরিবারের কান্না : আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ সপ্তাহ


রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে ২০১০ সালে নিখোঁজ হওয়া কমিশনার চৌধুরী আলমের কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মেয়ে মাহফুজা আক্তার। এসময় পাশেই ভিজা চোখে বসে ছিলেন তার মা হাসিনা বেগম।
শনিবার (২৮ মে) রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় যাদু ঘরের সামনে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দাও’ শীর্ষক প্রতিবাদ সমাবেশে তারা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে ২০১০ সালে নিখোঁজ হওয়া কমিশনার চৌধুরী আলমের কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মেয়ে মাহফুজা আক্তার। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা মো. কাওসার হোসেন যখন গুম হন, তখন তাঁর একমাত্র মেয়ের বয়স ছিল তিন বছর। মেয়েটি এখন ১২ বছর বয়সের কিশোরী।
গুম হওয়া কাওসারের স্ত্রী মিনু আক্তার বলেন, তাঁর মেয়ে এখন পুলিশ হয়ে বাবাকে খুঁজে বের করতে চায়। কাওসার যেদিন গুম হন, সেদিন রাজধানীর নাখালপাড়া ও বসুন্ধরা থেকে আরও সাতজন নিখোঁজ হয়েছিলেন। তিনি বরিশালে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। স্বামীর খবর শুনে ঢাকায় আসেন, শুরু হয় র্যাব-পুলিশের কাছে ছোটাছুটি। এখন আর ধরনা দেন না।
মিনু আক্তার আরও বলেন, ‘মেয়ে আগে বাবার খোঁজ করলে বলতাম বিদেশে গেছে। এখন সব বোঝে। “মাঝে মধে৵ বলে, মা আমি পুলিশ হবো। আমি নিজেই বাবাকে খুঁজে বের করব।’
প্রায় একই কথা বলেছে রেশমা আক্তার-মো. চঞ্চল দম্পতির ছেলে। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগ থেকে গুম হয়েছিলেন ছাত্রদল নেতা মো. চঞ্চল। তাঁদের একমাত্র ছেলের বয়স তখন তিন বছর। ওর ছেলেবেলাটা অন্যসব শিশুর মতো নয়।
রেশমা বলছিলেন, তাঁর স্বজনদের ছেলেরা বাবার হাত ধরে শুক্রবার নামাজ পড়তে যায়। তাঁর ছেলেকে যেতে হয় একা। তিনি ছেলেকে নিয়ে স্বজনদের সহযোগিতায় ঢাকা শহরে কোনো রকমে টিকে আছেন। কেউ কেন চঞ্চলকে খুঁজে বের করে দিচ্ছে না, একসময় এই প্রশ্ন করত ছেলে। এখন বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
শিশুটির মতো বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছে ঢাকার পল্লবী থেকে নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলামের ছেলেও। তরিকুলের স্ত্রী বেবী আক্তার গতকাল সমাবেশে বলেন, ১০ বছর আগে তাঁর স্বামী যখন গুম হন, তখন ছেলের বয়স ছিল ২২ মাস। বাবার জন্য কান্নাকাটি করত। এখন বুঝতে শিখেছে। সে বড় হয়ে ‘সরকারি কর্মকর্তা’ হতে চায়। তার বিশ্বাস, কেবল সরকারি কর্মকর্তা হলেই বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনের ছেলে শেখ শাহেদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিনি বলেন, সরকারকে জবাব দিতেই হবে। যত দিন না তিনি তাঁর বাবার খোঁজ পাচ্ছেন, তত দিন রাজপথ ছাড়বেন না। তাঁর দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা। পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তারপরও তাঁর বাবার কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কাঠগড় এলাকা থেকে নিখোঁজ হন লক্ষ্মীপুর হাজিরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও থানা বিএনপির সাংগাঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক। তাঁর ছেলে ইমন ওমর সমাবেশে অংশ নিয়ে বলেন, বাবা কেন নিখোঁজ তার জবাব চান তিনি। জবাব আদায় করেই ছাড়বেন।
সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন কল্পনা চাকমা ও মাইকেল চাকমার সহযোদ্ধারা, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের গুম হয়ে থাকা নেতা এবং বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের স্বজনেরা।
মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আখির সভাপতিত্বে ও মানবাধিকার সংগঠক মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা’র সঞ্চালানায় সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সংহতি জানান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান, গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ।
মিরপুর এলাকায় কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেন তিন বছর আগে গুম হন। তিনি বেঁচে আছেন কিনা জানে না তার পরিবার। গুমের পর থেকেই তার স্ত্রী নাসরিন জাহান স্মৃতির জীবনের প্রতিটি দিনই দুঃসহ স্মৃতির।
সাজ্জাদের সহধর্মিণী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন, তিনি স্বামীকে খুঁজে পেতে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা প্রথমে আশ্বাস দিলেও পরে আর খোঁজ নেননি। তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি দলের একজন নেতা তাদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকাও নিয়েছেন। সব মিলিয়ে ৪১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে বিভিন্নজনকে। কিন্তু তার পরও তার স্বামীকে ফেরত দেওয়া হয়নি।
রামপুরা থানা ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন অপুর মা, রাসেলের ভাই, ওমর ফারুকের ছেলেসহ আরও অনেকে তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন