গুলিবিদ্ধ পা নিয়েই ১০ দিন হেঁটেছেন রোহিঙ্গা তরুণ রফিক

বাইশ বছরের টগবগে তরুণ মো. রফিক। মিয়ানমারের রাচিডংয়ের সোয়াংপ্রাং গ্রামের বাসিন্দা। দশ দিন আগে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়া থাইংখালীর তাজমির খোলা ক্যাম্পে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে এখনও ব্যথায় কাতরাচ্ছেন তিনি। কোমর ও পায়ে গুলি লাগে তার। দুটি পা-ই প্রায় অবশ। সেই পা নিয়েই ১০ দিন হেঁটেছেন দুর্গম পথ। চিকিৎসার জন্য ছুটছেন এখান থেকে ওখানে। সর্বশেষ তাজমির খোলার একটি অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প থেকে চিকিৎসা নিলেও এখনও অসুস্থ তিনি।

সোমবার কথা হয় রফিকের সঙ্গে। মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারে ১০ সদস্য। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও একসময় সুখের সংসার ছিল তার। হঠাৎ করে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হওয়ার পর থেকে পাল্টাতে থাকে তাদের জীবন। ২০ দিন আগে রাচিডংয়ের সোয়াংপ্রাংয়ে সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায়। তবে আক্রমণ চালানোর সঠিক তারিখ মনে করতে পারছেন না তিনি। সেনাবাহিনী স্থানীয় মসজিদে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। ভয়ে লোকজন দিগি¦দিক পালাতে থাকে। যুবকরা আশ্রয় নেন গ্রামের একটি ঘরে। পরে তাদের লক্ষ্য করেও সেনারা গুলি চালাতে থাকে। এতে গুলি এসে লাগে তার কোমর ও পায়ে। সেনারা এসে যখন ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল তখন রফিক বাড়ির পাশের একটি পুকুরে নাক বাঁচিয়ে ডুবে থাকেন। রাতভর পুকুরে ডুবে থাকার সময় দেখেছেন গ্রামের সব বাড়ি-ঘরে দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেনারা টের পাবে তাই আবারও স্থান পরিবর্তন করে আশ্রয় নেন একটি ধানক্ষেতে। রফিক জানালেন, একদিনেই অন্তত ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করে মিয়ানমার সেনারা। একই দিন সোয়াংপ্রাং গ্রামে শতাধিক লোক গুলিবিদ্ধ হয় বলেও জানান তিনি।

পুকুরে ও ধানক্ষেতে রাত কাটানোর পর সকালে সীমান্তের উদ্দেশে রওনা দেন রফিক। কিছুদূর আসার পর আরও কয়েকজনকে সঙ্গী পান। বন-জঙ্গল ধরে হাঁটতে থাকেন তারা। ১০ দিন হেঁটে খেয়ে না খেয়ে পৌঁছান টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। টেকনাফের এক হৃদয়বান মৌলভীর সহায়তায় চিকিৎসা নেন স্থানীয় একটি হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ করে বালুখালীর উদ্দেশে রফিককে গাড়িতে তুলে দেন সেই মৌলভী। কথা হয় রফিকের বাবা হাফেজ আহাম্মদের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০ দিন আগে গুলিবিদ্ধ হলেও এখনও সুস্থ হয়নি তার ছেলে রফিক। তাজমিরখোলায় ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে শুনে ছেলেকে নিয়ে এখানে চলে এসেছেন। রফিক লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছেন। তরুণ রফিকের চিকিৎসা প্রদানকারী রেডক্রিসেন্ট চিকিৎসা ক্যাম্পের ডা. সোহেল জানান, রফিক মোটামুটি সুস্থতার দিকে। গুলির ক্ষতচিহ্ন না শুকানোয় হাঁটতে তার কষ্ট হচ্ছে। গুলিবিদ্ধ রফিকের থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তার (রফিকের) বাবা হাফেজ আহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। সীমান্ত দিয়ে পার হয়ে আসার পর থেকে সবাই নানাভাবে সহযোগিতা করছেন।

কক্সবাজার হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের অস্ত্রোপচার : মিয়ানমারে সেনা ও উগ্র বৌদ্ধদের হামলায় গুলিবিদ্ধ, আগুনে পোড়া ও জখম হয়ে পালিয়ে আসা অন্তত দেড়শ’ রোহিঙ্গা চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। চার বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৬৫ বছরের বৃদ্ধও আছেন আহতদের তালিকায়। এর মধ্য থেকে অতিমাত্রায় আহত ২৫ রোগীকে বাছাই করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন অর্থোপেডিক সার্জনরা। সোমবার সকাল থেকে বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির ১৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল জেলা সদর হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে অপারেশন কার্যক্রম শুরু করে। প্রথম দিনে এই টিম ৯ জনের অপারেশন সম্পন্ন করেছে।

আহত ও গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে এরই মধ্যে আলাদা ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। ওই ওয়ার্ডে রেখেই তাদের সব ধরনের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এই ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স উম্মে সালমা জানান, প্রথম দিনে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ৯ জন রোগীর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে। বাকিদের অস্ত্রোপচার মঙ্গলবার (আজ) করা হবে। আহতদের মধ্যে কারও দুই পায়ে, কারও হাতে, কারও বুকে গুলি লেগেছে।

সোমবার বিকালে গিয়ে দেখা যায়, মনসুর আলী নামে একজনকে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) থেকে বের করা হয়। তার দুই পায়েই ব্যান্ডেজ। জানতে চাইলে মনসুর আলী (৩৫) বলেন, তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর বুচিদং। তার বাবার নাম মোহাম্মদ কালু। মিয়ানমার সেনারা তার গ্রামে আক্রমণ করার পর প্রাণ বাঁচাতে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় সেনাদের ছোড়া গুলি তার দুই পায়ে লাগে। এরপর সীমান্ত পার হয়ে উখিয়া হয়ে কক্সবাজার হাসপাতালে চলে আসেন।

সূত্র জানায়, রাখাইনে সহিংসতার পর পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে খোলা হয়েছে আলাদা ওয়ার্ড। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এ হাসপাতালে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা চলছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ছাড়াও টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুতুপালং কমিউনিটি ক্লিনিক, ‘এমএসএফ’ হল্যান্ড হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালেও চিকিৎসা নিচ্ছে অহরহ রোহিঙ্গা রোগী। গুরুতর জখম রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয় হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা। কোনো রোহিঙ্গার শারীরিক অবস্থার অবনতি বা গুরুতর হলে তাদের পাঠানো হয় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় থাকা গুলিবিদ্ধ ও জখমপ্রাপ্তদের অস্ত্রোপচার শুরু হয় সোমবার।