গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের অসাধু চক্র দুদকের তালিকায়

দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর মামলার আসামি হতে যাচ্ছে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও বিভিন্ন বিষয়ে দূর্নীতি করা অসাধু চক্র। এই চক্রটির নেতৃত্বে রয়েছে সোহেল শেখ। তার ইশারাতেই দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের প্রতিটি শাখায় প্রকাশ্যেই চলছিল অনিয়ম ও দুর্নীতি। সোহেল শেখের সহযোগী হিসেবে এক নম্বরে রয়েছে অফিস সহায়ক কুদ্দুস গাজী, জমাদ্দার সরদার প্রমুখ।

জানা গেছে, হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা: জিবীতেষ বিশ্বাস এই হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে সোহেল শেখের কাছ থেকে গোপনে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তার সকল দূর্নীতি ও অনিয়মকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের পাশাপাশি রোগীদের মেডিসিন ও খাবার সরবরাহের টেন্ডার সহ হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকান্ডে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে আসছিল।

তাদের বানোয়াট মেডিকেল সার্টিফিকেটর কারণে অনেক নির্দোষ মানুষ দিনের পর দিন জেল খাটছে, আবার অনেক অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। পূর্বে এই চক্রটির অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হলেও অজানা কারণে এই চক্রটির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্ৰহণ করেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।

কয়েকমাস আগে এই চক্রটির বিরুদ্ধে শান্ত শিকদার (১৪) নামের এক বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছাত্রের মা হ্যাপি বেগম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, দূর্নীতি দমন কমিশন ও গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগ করেন।

অভিযোগে তিনি দাবি করেন, তার প্রতিবন্ধী ছেলের মেডিকেল সার্টিফিকেট টাকার বিনিময়ে পরিবর্তন করেছে জোমাদ্দার সরদার, সোহেল শেখ চক্র। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরে, গত বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওইদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগে দুদক অভিযান চালায়। প্রথমে দুদকের কর্মকর্তারা রোগী সেজে হাসপাতালের বিভিন্ন শাখায় চলমান অনিয়মের ভিডিও ধারণ করে। পরে তারা এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে অভিযান পরিচালনা করেন।

অভিযানে দুদক সমন্বিত গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মশিউর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি চৌকস দল অংশগ্রহণ করেন। এ সময় দুদকের কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন ধরনের নথি যাচাই, বেশ কয়েকজন চিকিৎসকসহ, সেবাপ্রত্যাশী রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের মন্তব্য গ্ৰহণ করেন।

দুদকের গোপালগঞ্জের সমন্বিত জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সদর হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিকিৎসক অনুপস্থিত, এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিন আট বছর অকেজো পড়ে থাকা, স্টোর রেজিস্ট্রার আপ টু ডেট না রাখা, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের টাকার বিনিময়ে পুলিশ কেসের মেডিকেল সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে।

এছাড়াও সরকারি নির্ধারিত টাকার পরিবর্তে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত টাকা আদায়, এক্স-রে মেশিনের ফ্লিম না থাকার অজুহাতে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিকে রোগী প্রেরণ করার প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক।

দুদকের সহকারী পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, হাসপাতালের এমআরই, সিটি স্ক্যান মেশিন দীর্ঘ আট বছর ধরে অচল রয়েছে। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি সিন্ডেকেট ইচ্ছাকৃতভাবে মেরামত না করে রোগীদের উচ্চ মূল্যে স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে বাধ্য করেন। ওই সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গোপন লেনদেন রয়েছে বলে অভিযোগে জানা গেছে। ইসিজি করিয়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা নিচ্ছেন। রোগীদের জিম্মি করে ট্রলিম্যানদের টাকা আদায়ের ও সত্যতা পাওয়া গেছে।

তিনি আরও বলেন, এ সকল বিষয় উল্লেখ করে প্রধান কার্যালয়ে লিখিত প্রেরণ করা হয়েছে। প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমতি পাওয়ার পরে আইনগত ব্যবস্থা গ্ৰহণ করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী জানায়, সহকারী পরিচালক ডা: জীবিতেষ বিশ্বাস অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে জোমাদ্দার সরদার, সোহেল শেখ, অফিস সহায়ক কুদ্দুস গাজী সহ পুরো চক্রটিকে সেল্টার দিচ্ছেন।

তারা আরো জানান, সোহেল শেখ সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে গাড়ি, বাড়ি ও ফ্লাট সহ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। সে টাকার গরমে দেড় লাখ টাকা মূল্যের কুকুর ও ৮০ হাজার টাকা মূল্য মানের বেশকিছু কবুতর পালন করেন।

তবে এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জোমাদ্দার সরদার, সোহেল শেখ ও অফিস সহকারী কুদ্দুস গাজী।

গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বলেন, টাকার বিনিময়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট বাণিজ্য, হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারে রোগীদের থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়, দীর্ঘদিন এমআরআই, সিটি স্ক্যান, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন অকেজোসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ নিয়ে দুদকের একটি দল তদন্তে এসেছিল।

তারা প্রতিটি শাখায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন অনিয়মের সাথে যুক্ত নই। আমাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে একটি মহল অনিয়মের সাথে জড়িয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ বিষয়ে আমার দপ্তর থেকে ইতোমধ্যে কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। যে সকল পর্যায়ে ত্রুটি পরিলক্ষিত হবে সেগুলো ঢেলে সাজানো হবে।