গোড়ায় গলদ রেখে সমাধানের চেষ্টা, অবর্ণনীয় দুর্ভোগে যাত্রীরা

রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীর সড়কে হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে লেগুনা ও হিউম্যান হলার। অনুমোদন ছাড়াই ফিটনেসবিহীন এসব যান দীর্ঘদিন ধরে চলছিল রাস্তায়।

অপেক্ষাকৃত কম ভাড়া হওয়ায় ঢাকার নিম্নবিত্ত এবং শিক্ষার্থীরা যাতায়াতের জন্য নির্ভর হয়ে উঠেছিল এসব বিপজ্জনক যানবাহনে। কিন্তু বিকল্প যানবাহনের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করেই এগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় গতকাল বুধবার সারা দিনই কয়েকটি রুটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে যাত্রীরা। বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। অসুস্থ রোগীদের ভোগান্তি ছিল দুঃসহ।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর গত এক মাসে ঢাকার রুটগুলোতে সংকট চলছে গণপরিবহনের। এবং মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে হাজির হয়েছে লেগুনা বন্ধ করার বিষয়টি। দুর্ভোগে পড়া যাত্রীদের অভিযোগ, বিভিন্ন রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচলের সুযোগ আছে, এ রকম পর্যাপ্ত বাস না নামিয়ে ঢাকার রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। পুরো পরিবহন সেক্টরকে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ায় বছরের পর বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছে সীমাহীন নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনা। এর জন্য প্রশাসনের দুর্নীতি ও গাফিলতিও সমানভাবে দায়ী। তাই শৃঙ্খলা ফেরাতে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক সেটা গোড়ায় গলদ রেখেই সমাধানের মতো হবে। ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে রাজধানীর সড়কে বিশেষ ট্রাফিক কর্মসূচি চলবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো, যানজট কমানো এবং ট্রাফিক আইন মানতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে নানা কর্মসূচি নিয়েছে পুলিশ। এর অংশ হিসেবে গতকাল ঢাকার সড়কের চেনাচিত্র কিছুটা বদলে যায়। বিশেষ করে যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের অনেকটাই ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। পুলিশ, আনসার ও রোভার স্কাউটের সদস্যরা গলদঘর্ম হলেও মানুষজনকে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কোথাও কোথাও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে মানুষদের। সম্প্রতি সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে দেশে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ বিক্ষোভ হয়েছে। দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ২৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা রাস্তা নেমে আসে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পুলিশ পর্যন্ত স্বীকার করেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সবার চোখ খুলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের দেখানো সে পথেই সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে রাস্তায় নেমেছে পুলিশ।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে পরিবহন সংকট মেনে নিলেও পুলিশের অভিযানের কারণে সৃষ্ট পরিবহন সংকট মেনে নিতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। কারণ তারা মনে করছেন- পুলিশ গোড়ায় হাত না দিয়ে লোক দেখানো ট্রাফিক কর্মসূচি চালাচ্ছে। সড়কে যত অব্যস্থাপনা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চলে তার বেশিরভাগেই পুলিশ সদস্যরা সরাসরি জড়িত রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন তারা।

আবুল ফয়েজ নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী যিনি মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা, তিনি গতকাল বুধবার বলেন, ‘পুলিশ জনস্বার্থ দেখার বদলে গাড়ির মালিকদের স্বার্থটাই বেশি দেখে। এই যে রাজধানীতে লেগুনা চলাচল বন্ধ করল-তাদের ভাবা উচিত ছিল না, এতে কত মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে? বিকল্প পরিবহনের ব্যবস্থা না করে হুট করে এ যানবাহনগুলো বন্ধ করা কোনো কাজের কাজ নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জানি এসব যান অনিরাপদ। একটু এদিক-ওদিক হলেই উল্টে যায়। কিন্তু আমরা তো নিরুপায় হয়ে যাই। আমি প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে এসে ফার্মগেট ওয়্যারলেসে অফিস করি। এই রুটে পর্যাপ্ত বাস নেই। যে দুয়েকটা বাস আছে তার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এ লেগুনাগুলো আমাদের সেই আপদে সেবা দিচ্ছে। কই সরকার কিংবা পুলিশ তো কখনো এসব রুটে প্রয়োজনীয় বাসের ব্যবস্থা করেনি।’

শারমিন সুলতানা নামের আরেকজন বেসরকারি চাকুরে জানালেন তিনি প্রতিদিন খিলগাঁও থেকে গুলিস্তান যাতায়াত করেন লেগুনায়। হঠাৎ করে এসব যান বন্ধ করে দেওয়ায় পড়েছেন মহাবিপদে। কারণ এ রুটে কোনো বাসই চলাচল করে না। ফলে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে তাকে রিকশায় যাতায়াত করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘বিআরটিসির গ্যারেজে শত শত বাস পড়ে থাকে। এ আপদকালীন সেসব বাস নামালেই পারে সরকার। কিন্তু তারা সেটা করবে না কারণ এতে পরিবহন মালিকদের ক্ষতি হবে। সরকার জনগণের ক্ষতি চাইলেও বাস-মালিকদের ক্ষতি চাইবে না। এটাই এ দেশের নিয়ম।’

গত মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, মহানগরীতে লেগুনা চালানোর অনুমোদন নেই। তাই লেগুনা চলতে দেওয়া হবে না। নগরীর বাইরে এসব লেগুনা চলতে পারে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি-বিএরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে অনুমোদিত লেগুনা রয়েছে ২ হাজার ৫২৫টি। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। প্রতিটি লেগুনা প্রতি ট্রিপে ১২ জন করে যাত্রী বহন করতে পারে। সে হিসাবে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে সেবা দিচ্ছিল লেগুনাগুলো। কিন্তু ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে নিশ্চিত কার হচ্ছে যাতে নগরীতে লেগুনা চলাচল করতে না পারে। লেগুনা না থাকায় যাত্রীরা যখন ভোগান্তিতে পড়েছে তখন এ সুযোগে রাস্তায় নেমেছে বিভিন্ন মিনিট্রাক ও পিকআপ ভ্যানগুলো। অসহায় যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই এসব পিকআপ ও মিনিট্রাকে গন্তব্যে ফিরতে দেখা গেছে মঙ্গলবার থেকে।

মো. আছাদুজ্জামান মিয়া জানান সেপ্টেম্বরজুড়ে রাজধানীতে বিশেষ ট্রাফিক কর্মসূচি চলবে। ট্রাফিকের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, যানজট কমানো এবং সবাইকে আইন মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করাই হবে এ কর্মসূচির লক্ষ্য। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য প্রতি পালায় ৩২২ জন করে রোভার স্কাউট থাকবে বলে জানান তিনি। এরই মধ্যে নগরীর ১২১টি বাস স্টপেজ চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেসব স্টপেজে সাইনবোর্ড লাগানোর কাজ চলছে। যেখানে সেখানে যাতে বাস থামানো না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া জাহাঙ্গীর গেইট থেকে জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত মডেল করিডোর করে অটো সিগনালের মাধ্যমে ট্রাফিকিং করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পরবর্তী মাস থেকে এটা অন্য সড়কেও চালু করা হবে। ডিএমপি কমিশনার বলেন, রাজধানীর বাসগুলোকে ৬টি কোম্পানির মাধ্যমে চালানোর ব্যাপারেও ভৌত অবকাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের এসব কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু এতেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত জুন মাসে ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। সে নির্দেশনা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মৌলিক ভূমিকা রাখবে। সেখানেই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- এক চালককে দিয়ে ৫ ঘণ্টার বেশি বাস না চালানো, রাস্তা পারাপারে আধুনিক ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেওয়া এবং চালক ও সহকারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। দূরপাল্লার যাত্রায় বিকল্প ড্রাইভারের ব্যবস্থা করা; পথে চালকদের জন্য বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ড্রাইভার-হেলপারদের প্রশিক্ষণ, রাস্তা পারপার ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার বিষয়টি নিয়ে উদাসীন।-সৌজন্যে : খোলা কাগজ।