ঘাটতির শঙ্কা রেখেই প্রস্তুত এবারের জাতীয় বাজেট
বিদেশি ঋণ সুবিধা কাজে লাগাতে কখনোই ভালো করতে পারেনি সরকার। বাজেটে ঘাটতি পূরণে বড় অংকের বিদেশি ঋণ সুবিধা যোগ করা হচ্ছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন বরাবরই ৩০ শতাংশের নিচে। এর ফলে বাজেট ঘাটতি যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ইতিহাসে ২০১৬ সালে মোট বিদেশি ঋণের সর্বোচ্চ ২৭ হাজার কোটি টাকা কাজে লাগাতে পেরেছে সরকার। এবছর অর্থাৎ ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৬ হাজার কোটি টাকা।
বৈদেশিক ঋণ সুবিধা কাজে লাগাতে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারি টাকা খরচের ব্যাপারে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের আগ্রহ বেশি। এখানে এতো বেশি নিয়ম কানুন না মানলেও চলে। সেখানে বড় কোনো শর্ত থাকে না। বিদেশি টাকা নেওয়ার বিষয়ে যখন এমওইউ চুক্তি সই হয়, তখন সেখানে বেশকিছু শর্ত উল্লেখ থাকে। ইচ্ছেমতো বিদেশি টাকা এদিক-ওদিক করা যায় না। আর এসব শর্তের ব্যত্যয় হলে তারা ফান্ড রিলিজ করে না।
সূত্র জানায়, জিওভির টাকার ক্ষেত্রে এতো বেশি নিয়ম-কানুন না মানলেও চলে। ফলে সবার টেনডেনসি হচ্ছে বাজেটে আসা জিওভি অংশ আগে খরচ করা। এটা অনেক সহজ। এখান থেকে ফান্ড রিলিজ করতে পরিশ্রমও কম, নেই বললেই চলে। এখানে কঠিনভাবে নিয়ম মানতে বাধ্য করার মতো কেউ নেই। এতো সহজে জিওভির টাকা পেলে বিদেশি ফান্ডের ইউটিলাইজ কেমনে হবে?
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ডোনারদের (বৈদেশিক ঋণ দাতা) টাকা খরচ করতে তাদের চুক্তিতে উল্লিখিত শর্তের শতভাগ মানতে বাধ্য করা হয়। আর এ শর্ত মানতে না পারলে তারা অর্থ ছাড় দেন না। এজন্যই এ টাকা খরচ হচ্ছে না। ফলে বাজেট ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। বাজেটে ঘাটতি মেটাতে বিদেশি সহযোগিতা যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে তা খরচ না হওয়ায় বাজেটে বড় অসামঞ্জস্য থাকছে প্রতি বছর।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা সূত্রে জানা যায়, গেল ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ৭৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের সহায়তার কথা উল্লেখ ছিল। সে বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণের সহায়তা আসে। যার পরিমাণ মাত্র ২৭ হাজার কোটি টাকা। যেসব কারণে বৈদেশিক ঋণ ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না, সে কারণগুলোর সমাধান জরুরি। তা না করে শুধু শুধু প্রতিবছর বড় অংকের বাজেট প্রদর্শন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা জানায়, আসছে বাজেটে অর্থাৎ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি মেটাতে এডিপিতে ব্যবহারের জন্য মোট ৬০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের সহায়তার উল্লেখ করা হয়েছে।
বাজেট প্রস্তুতের সাথে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এবারও হয়তো এর সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ টাকা খরচ করা সম্ভব হবে না। কারণ এবছর নির্বাচনী বছর। নির্বাচনের জন্য তিন মাস ব্যস্ত থাকবে সবাই। ইলেকশনের তিন-চার মাস তো এডিবি বাস্তবায়নে তেমন মনোযোগ থাকবে না। তাই এবছরেও বাজেটে অসঙ্গতি তৈরি করবে।
প্রতিবেদকের কথা হয় সিপিবির সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ বাজেটেও ধনী ব্যক্তিদের আরও ধনী করতে সব ধরনের ব্যবস্থা থাকছে। আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম সম্পদ পুনঃবণ্টন করে গরিবদের দেওয়ার জন্য। আমরা স্বাধীনতাকে পরিত্যাগ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পরিত্যাগ করেছি। আমাদের উচিত বিদেশি সহজ সুদে ঋণ গ্রহণ করে তা কাজে লাগানো। এক্ষেত্রে বরাবরই সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ঋণদাতা বিদেশি সংস্থার স্ট্যান্ডার্ড বাস্তবায়নে আমাদের সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বাজেটে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ সুবিধা যোগ হচ্ছে, বছর শেষে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, শুধু শুধু মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হলে হবে না। প্রত্যেকটি মানুষের ঘরে ঘরে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পৌঁছে দিতে হবে। একজন গার্মেন্টস কর্মী বছরে পায় ৬০ হাজার টাকা। তার বাকি ৮০ হাজার টাকা কই যায়? এজন্য বাজেট আসলে বড়লোক ও বিত্তবানদের সিন্ডিকেট।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটের আয়-ব্যয়ের যে পার্থক্য হয়, সেটা পূরণ করা হয় বৈদেশিক ঋণ দিয়ে। আমরা বলেছি এটা বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ ঋণের দায়ভার কমাতে বাইরের ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি পাইপলাইনে অনেক প্রকল্পের কাজ জমে যাচ্ছে। বিদেশি সাহায্যভুক্ত প্রজেক্ট বাস্তবায়নের হার কম। যেহেতু বাইরের ঋণ পরিসেবার রেকর্ড ভালো এজন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের উপর চাপ কমানো উচিত।
তিনি বলেন, ব্যয় এবং আয়ের একটা ঘাটতি আছে। এ ঘাটতি হয় অভ্যন্তরীণ থেকে করতে হবে, নয়তো বৈদেশিক ঋণ সুবিধা থেকে করতে হবে। যখন আমরা প্রতি বছর উল্লিখিত বৈদেশিক ঋণ থেকে মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছি তখন চাপটা পড়ছে অভ্যন্তরীণের উপর। এতে ঋণের দায়ভার অনেক বেশি। আমরা বলেছি বৈদেশিক ঋণের বাস্তবায়নের হার অনেক কম। এটা কিভাবে শক্তিশালী করা যায় সেই পদক্ষেপ নিন। বিদেশি ডোনারদের অর্থছাড়ে আমাদের যে দুর্বলতাগুলো আছে সে জায়গায় নজর বাড়াতে হবে।
বিশ্লেষকদের দাবি, এই বৈদেশিক ঋণ সুবিধা চুক্তির পরেও তা বাস্তবায়নে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এসব প্রজেক্ট বাস্তায়নে জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব হওয়া। উপাদানাদী সংগ্রহেও অনেক সময় লেগে যায়।
এছাড়াও বিদেশিরা প্রতিটি প্রকল্পে ধাপে ধাপে টাকা দেন। প্রথম ধাপের টাকা যথাযথ ইউটিলাইজ হয়েছে কি না, তা দেখার পর আরেক ধাপের টাকা ছাড় দেন। অনেক সময় শর্ত মানতে ঠিকাদারদের গরিমসির কারণেও ডোনাররা অনুৎসাহিত হন। সরকারের ইচ্ছেমতো ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনও বৈদেশিক ঋণ সুবিধা বাস্তবায়নে বড় প্রতিবন্ধকতা।
সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের ভাষ্য, সৎ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে না পারায়ও বিদেশি ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। এসব বিষয় তো পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডির তদন্তেও ধরা পড়েছে। সেগুলোর সমাধান হচ্ছে না কেন?
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন