ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা
আগাম বন্যায় গত বছর হাওরাঞ্চলের কৃষকরা এক মুঠো ধানও গোলায় তুলতে পারেননি। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে চোখের সামনে নষ্ট হয় তাদের বহু কষ্টের ফসল। কৃষক কেঁদেছে অঝোরে। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বাম্পার ফলন হওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর তারা। হাওরজুড়ে এখন মিশ্রাবস্থা।
কোথাও পাকা ধানের ম-ম গন্ধ। আবার কোথাও সবুজের সমারোহ। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। হাওরের কিছু এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বোরো ধান কাটা পুরোদমে শুরু হবে। ১৫ দিনের মধ্যে উফশী ধান ঘরে তুলতে শুরু করবে কৃষক। তবে এখনো ভয় আবহাওয়া নিয়ে। আকাশে মেঘ দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন কৃষক। এর সঙ্গে রয়েছে শ্রমিক সঙ্কট। ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকার কমে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
সিলেট : সিলেটের হাওরে হাওরে এখন সোনালি ধান। কোথাও ধান কেটে ঘরে তুলতে শুরু করেছেন কৃষকরা। ধান কাটার শ্রমিকের জন্য খবর পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। মেরামত করা হচ্ছে ধানের গোলা। ধান শুকানো ও মাড়াইয়ের জন্য লেপে মুছে তৈরি করা হচ্ছে ধানের খলা। ব্যস্ততার কারণে এখন বিয়ের অনুষ্ঠানে পর্যন্ত যাচ্ছেন না অনেক কৃষক। তবে শ্রমিক সঙ্কটই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা বলে জানিয়েছেন তারা।
বালাগঞ্জ উপজেলার মাইজাইল হাওরপাড়ের কৃষক জমসেদ আলী জানান, একজন শ্রমিককে ৪০০-৫০০ টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে। বন্যা বা শিলাবৃষ্টি যেন না হয় সেই দোয়া করছেন তিনি। সিলেট কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় এবার ৮৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সিলেট জেলা প্রশিক্ষক সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, আবহাওয়ার আগামী ৭ দিনের যে পূর্বাভাস পাওয়া গেছে তাতে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সিলেটের অতিরিক্ত আঞ্চলিক পরিচালক মো. আলতাবুর রহমান বলেন, এ মাসের ১৫-১৬ তারিখ পর্যন্ত সময় পাওয়া গেলেও ৬০ ভাগ ধান ঘরে তোলা সম্ভব হবে।
কিশোরগঞ্জ : জেলার প্রত্যন্ত হাওরগুলোয় গত বছরের মতো এবছরও প্রকৃতির বৈরী আচরণ নিয়ে কৃষকরা আতঙ্কিত। নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত শিলায় নিকলীর কোনো হাওরে ফসলের ক্ষতি হয়নি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হবে এ জেলায়।
জেলার ইটনা হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। উপজেলার কয়েকটি হাওরে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। লাইম পাশা গ্রামের কৃষক রওশন আলী জানান, ধারদেনা করে ৩ একর জমি চাষ করেছি। এর মধ্যে ১ একর জমির ধান কাটতে পেরে খুব ভালো লাগছে।
কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলার মধ্যে প্রায় অর্ধেক জমিই হাওরাঞ্চলে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, এসব উপজেলায় এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ২৮২ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন আর অষ্টগ্রামেই জেলার অর্ধেক বোরো জমি আবাদ করা হয়। এই তিন উপজেলায় এবার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৭ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমি।
সুনামগঞ্জ : জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন ধানকুনিয়া হাওরে গত তিন দিন ধরে ধান কাটা চলছে। গত শুক্র ও শনিবারের শিলাবৃষ্টিতে হাওরের উঁচু এলাকায় ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে তবে নিচু জমির জন্য বৃষ্টি ছিল আশীর্বাদ। গত বুধবার জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার হাওরের বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এ সময় তিনি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বোরো ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, জেলায় মোট ২ লাখ ২২ হাজার ৭২৯৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ১১ উপজেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ২১ হাজার ৭৯২ মেট্রিক টন। হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, কৃষকরা এবার ধান কেটে ঘরে তুলতে পারলে গত কয়েক বছরের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস বলেন, ভারত থেকে ঢলের পানি এলেও নদী ও হাওরে পৌঁছতে কমপক্ষে ১০-১২ দিন লাগবে। এর মধ্যেই কৃষকরা ধান কেটে ফেলতে পারবেন।
নেত্রকোনা : চলতি বোরো মৌসুমে জেলার খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ ও কলমাকান্দা উপজেলার কয়েকটি হাওরের কিছু অংশে ব্রি-২৮ জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সবক’টি হাওরে পুরোদমে শুরু ধান কাটার উৎসব।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল জানান, খালিয়াজুরী উপজেলার পুরোটিই হাওরাঞ্চল। এখানে এবার বোরো আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে। তা ছাড়া, জেলার মদন, মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা, আটপাড়া ও কেন্দুয়া উপজেলার হাওরাঞ্চল অধ্যুষিত অংশে বোরো রোপণ হয়েছে ২১ হাজার ৯০ হেক্টর জমিতে। ওই সব জমির ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় দেড়শ’ মেট্রিক টন।
খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি কৃষক তপন বাঙ্গালী জানান, এবারের বাম্পার ফলনে সবাই খুশি। আমাদের এক একর জমিতে উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার টাকা। ধান হবে অন্তত ৫০ মণ। খালিয়াজুরী সদরের আরেক কৃষক মনির হোসেন বলেন, শ্রমিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারা আর ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়াই আমাদের প্রত্যাশা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন