ঘুষ দিলেই জমির খাজনা কমে দেন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা!

জমি সংক্রান্ত সেবা পেতে নওগাঁর বদলগাছীতে এক ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে গ্রাহকদের দিতে হয় ঘুষ। অভিযোগ ঘুষের বিনিময়ে জমির খাজনা কমে দেন ওই কর্মকর্তা।

এছাড়া অভিযোগ আছে, ভূমি সহকারী ওই কর্মকর্তা স্থানীয় দালালের মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে থাকেন। দালালের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। অফিসে দালাল থাকে সবসময়। এমন তথ্যের সত্যতাও মিলেছে ওই ভূমি অফিসে।

ফলে সেবা নিতে গিয়ে একদিকে হয়রানি থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে ঘুষের বিনিময়ে কাজ করে নিতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের।

ওই কর্মকর্তার নাম রাসেল হোসেন। তিনি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার মিঠাপুর-মথুরাপুর-পাহাড়পুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তিনটি ইউনিয়নের এই একটি মাত্র অফিস যেন ঘুষ বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।

ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রাসেলেকে ঘুষ দিলে ৭০ হাজার টাকার খাজনা এক লাফে নেমে হয়ে যায় ৫ হাজারে। আবার কারো ২৮ হাজার টাকার খাজনা হয় ৫৭১ টাকায়। এভাবেই ঘুষ নিয়ে কাজ করে দেন ওই কর্মকর্তা। এমনকি ঘুষের বিনিময়ে ৪লাখ টাকার খাজনা দুই হাজার টাকায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে ঘুষ নিয়ে সেবা দেওয়ায় এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সোহেল রানা সেখানে তদন্ত করতে গেলে এক জটলার সৃষ্টি হয়। ভুক্তভোগীদের তোপের মুখে পড়েন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রাসেল হোসেন।

অপরদিকে তদন্ত প্রায় ৩ সপ্তাহ পার হলেও রাসেল হোসেনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তারা।

ঘটনাটি গত প্রায় এক মাস আগে উপজেলার ওই ভূমি অফিস এলাকায় ঘটে।

জটলার এক ভিডিও ক্লিপ হাতে এলে অনুসন্ধানে নামে এই প্রতিবেদক। গত এক সপ্তাহ ধরে উপজেলার একাধিক ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলা হয়। পাওয়া যায় বিস্তর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। কেউ কেউ চাইলেন ঘুষের টাকা ফেরত আবার কেউ চাইলেন বিচার।

অনুসন্ধানকালে সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ- জমির খাজনা বাবদ, খারিজের প্রতিবেদন-প্রস্তাব, নামজারির রেকর্ড সংশোধন সহ সব ক্ষেত্রেই টাকা ছাড়া মিলছেনা সেবা। খাজনার পরিমান দেখে চুক্তি করা হয় টাকা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ প্রথমে খাজনা রশিদে টাকার পরিমান বেশী দেখান ওই সহকারী কর্মকর্তা। এরপর ঘুষ দিলে খাজনার পরিমান হয়ে যায় শতকের ঘরে। চাহিদা মত ঘুষ দিলেই মেলে কাজ, না দিলেই সেবাপ্রত্যাশীদের মাসের পর মাস হয়রানিতে পড়তে হয়।

জমির খাজনা দিতে গিয়েছিলেন ফাতেমা বেগম নামের এক নারী। প্রথমে তার কাছে চাওয়া হয়েছিল ২৮ হাজার টাকা। এরপর ২০ হাজার টাকা ঘুষ দেওয়ায় তার খাজনা হয়ে যায় ৫৭২ টাকা। রশিদ পেয়ে চোখ তার কপালে।

ভুক্তভোগী ফাতেমা বেগম বলেন,“আমি জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য ভূমি অফিসে চেক তুলতে গেছিলাম। আমার কাছে ২৮ হাজা টাকা চাওয়ায় আমি দিতে পারিনি। পরে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ৫৭২ টাকা চেকে তুলে দিছে।

আমি এই ৫৭২ টাকার চেক দেওয়ায় বাঁকী টাকা ফেরৎ চাই এবং বলি আমি গরীব মানুষ স্যার। তখন তিনি বলেছে তাই কম নিছি আমরা। আমি আমার টাকা ফেরৎ চাই”।

আরেক জন দুর্গাপুর গ্রামের সুজাউল। তিনি শ্বশুরের জমির খাজনা দিতে গিয়েছিলেন। প্রথমে তিনটা খতিয়ান মিলে ৬৯ হাজার ৪১৪ টাকার রশিদ দেখায় তহশিলদার রাসেল হোসেন। এরপর ৩০ হাজা টাকা ঘুষের বিনিময়ে নেমে যায় ৫হাজার ৮৪২ টাকায়। রশিদ পেয়ে তারও চোখ কপালে।

ভুক্তভোগী সুজাউল বলেন, আমার শ্বশুর খুব অসুস্থ। তার দুটো কিডনিতেই সমস্যা। চিকিৎসার জন্য ৫ শতাংশ জমি বিক্রি করবে। তাই শ্বশুরের তিন খতিয়ানের ১৫ শতাংশ জমির খাজনা দিতে গিয়েছিলাম ভূমি অফিসে। প্রথমে ওই পরিমাণ টাকা চাওয়ায় আমি হতাশ হই। এবং জানতে চাইলে তহশিলদার রাসেল বলেন কোন কিছু করার নেই। কিন্তু পরে ৩০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে ৫হাজার ৮৪২ টাকার খাজনার অনলাইন রশিদ হাতে পাই। আমি সহ আমার মতো সাধারণ কৃষকের কাছ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রাসেল হোসেন।

তিনি আরও বলেন, আমার দেওয়া এই ৩০ হাজার টাকা কে পাবে এটা ভেবেই আমি অভিযোগ দিই। আমার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঘটনার দিন এডিসি স্যার আমার কাছ থেকে সব কিছু শুনেছে। আরও বেশ কয়েক জন ভুক্তভোগী সেখানে উপস্থিত হয়। আমি তার উপযুক্ত শাস্তি ও বিচার চাই।

মথুরাপুর ইউপির তৌহিদ হোসেন জানান, আমার কাছে তিন খতিয়ান মিলে ৪ লাখ টাকার রশিদ দেখায়। পরে এক মহুরীকে নিয়ে গিয়ে ২ লাখ টাকা ঘুষ দিলে ২ হাজার ২০০ টাকার খাজনা রশিদ দেয়। ওই কর্মকর্তা এখনও কিভাবে আছে ওই অফিসে, ওর তো চাকরি থাকার কথা নয়। সেদিন এডিসি স্যার সময় স্বল্পতার কারণে আমাদের সকলের কথা শুনতে পারেনি। প্রায় ৪০-৫০ জন ভুক্তভোগী তাদের অভিযোগ নিয়ে আসছিলো।

তবে ঘুস নেওয়া বিষয়ে অভিযুক্ত রাসেল হোসেন ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হয় নি।

বুধবার ৩ সেপ্টেম্বর জানতে চাইলে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান ছনির মুঠোফোনে বলেন, রাসেল হোসেনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তের পর জানা যাবে।

এছাড়া ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর একাধিক সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে দেখবো এবং সঠিক হলে সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিন জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সোহেল রানা মুঠোফোনে বলেন, ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরজমিনে গিয়েছিলাম। তদন্ত চলমান আছে। এছাড়া অন্যান্য ভুক্তভোগীর অভিযোগের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চান না উর্দ্ধতন এই কর্মকর্তা।