চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮
পুরান ঢাকার চকবাজারের পাঁচটি ভবনে বুধবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ডের পর এ পর্যন্ত ৭৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। আগুনে দগ্ধ ও আহত হয়েছেন পথচারীসহ অর্ধ শতাধিক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত আমাদের মর্গে (মেডিকেল কলেজ মর্গ) ৬৭টা লাশ পেয়েছি। আরো ১১টা লাশ আমাদের হাসপাতালে মর্গে আছে। এই টোটাল ৭৮টা লাশ। ৭৮টা লাশের মধ্যে কিছু কিছু লাশ আছে তাদের চেহারা দেখে শনাক্ত করা যাবে। কিছু কিছু লাশ আছে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট লাগবে, ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে শনাক্ত করা যাবে। কিছু কিছু লাশ আছে চেহারা এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে শনাক্ত করা যাবে না, তাদের আমরা ডিএনএ প্রফাইলিংয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করব।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পুরান ঢাকায় নন্দকুমার সড়কের চুড়িহাট্টায় বুধবার রাতে দিকে শাহী মসজিদের সামনে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এর পরই পাশের খুঁটির আরো দুটি ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের শব্দ তারা শুনেছেন। তারা বলেন, মুহূর্তেই আগুন লাগে জামাল কমিউনিটি সেন্টারে। আগুনের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা ওয়াহিদ ম্যানশনে। ভবনটির প্রথম দুইতলায় প্রসাধন সামগ্রী, প্লাস্টিকের দানা ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদাম থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের আরো চারটি ভবনে। পাশের কয়েকটি খাবারের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারেরও বিস্ফোরণ ঘটে। পুড়ে যায় সড়কে থাকা একটি প্রাইভেট কারসহ কয়েকটি যানবাহন। এ সময় পুড়ে যাওয়া কয়েকটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। রাজধানীর প্রায় সবকটা ইউনিট কাজ করে আগুন নেভাতে। খুবই ঘন বসতি এবং রাস্তা সরু হওয়ায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে।
ঘটনাস্থলে দায়িত্বপালন করা ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, যেহেতু এখানে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ আছে, এগুলো খুবই বিস্ফোরণ ঘটছে। এগুলোর টেম্পার অনেক বেশি। এগুলোর সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে আমাদের ফায়ার ফাইটিং করতে হচ্ছে। রেসিডেনশিয়াল এরিয়াতে কোনো কেমিক্যালের গোডাউন থাকার কথা না।
চকবাজার এলাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সংযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন করে আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট একযোগে কাজ করেছে। আশপাশের ভবনগুলো খালি করে সেখানকার বাসিন্দাদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বরত কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে জানান, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় রাসায়নিক গোডাউন থেকে এ আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে মুহূর্তেই পাশের ভবনগুলোতে এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের উপপরিচালক (অপারেশন্স ও মেইনটেনেন্স) দিলীপ কুমার ইউএনবিকে বলেন, ভোর ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও অন্য ভবনগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ায় আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগবে।
হাসপাতালে লাশের মিছিল
অগ্নিদগ্ধ ও আহত অন্তত ৬০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ জন। এরমধ্যে অগ্নিদগ্ধ চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
দগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন তাঁরা হলেন রেজাউল (২১), জাকির হোসেন (৫০), সেলিম (৪৫), আনোয়ার (৫০), মোস্তাফিজ (৪০), জাহিদুল (২৮), ইভান (৩০), মাহমুদ (৫৭), রামিম (১২), সালাউদ্দিন (৫০), মোজাফ্ফর হোসেন (৩২), সোহাগ (২৬), সোহান (৩৫), ফজর আলী (২৫), হেলাল (২৫) ও সুজন (৪০)।
আহতদের মধ্যে আল আমিন (৩৫), কাউছার (৩০), জাহাঙ্গীর (২৩), ছালাম (৩০), রবিউল (৪০), সালাউদ্দিন (৩৪), আনিছুর রহমান (৫০), তানজিল (১৪) ও রমজানের (১২) নাম জানা গেছে। আগুন দেখে হুড়োহুড়ি করে ভবন থেকে নামতে গিয়ে তাঁরা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এক চিকিৎসক জানান, ক্লোজ জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। সবারই শ্বাসনালি পুড়েছে কমবেশি। চারজনের বেশি পুড়েছে। তাদের অগ্নিদগ্ধের পরিমাণও বেশি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আজ সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ৬৫ জনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেলে এসেছে। এঁদের মধ্যে ৫৭ জন পুরুষ, তিনজন শিশু ও পাঁচজন নারী। বেশির ভাগ মরদেহ মর্গে রাখা আছে। কিছু মরদেহ জরুরি বিভাগে রাখা আছে। অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জন দগ্ধ হয়েছেন। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। জরুরি বিভাগ ও বার্ন ইউনিটে তাদের চিকিৎসা চলছে।
সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্মী সিরাজুল ইসলাম ও সিনিয়র স্টাফ নার্স পারভীন বেগম জানান, চকবাজারে নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭৬ জনের লাশ এসেছে ঢাকা মেডিকেলে। এর মধ্যে ৬৫ জনের মরদেহ মূল মর্গে এবং ১১ জনের মরদেহ জরুরি বিভাগে রাখা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ১৬ জনের মৃতদেহ শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে হাসপাতালে ভিড় করছেন তাঁরা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন