চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকতে ৫০০ দোকান, ডিসির ইশরায় ৫ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য গিলে খাচ্ছে বৈধ-অবৈধ ভাসমান ৫ শতাধিক দোকান। এসব অবৈধ দোকান থেকে বছরে ৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। এমন কি চাঁদা আদায়কারীরা এসব টাকার একটি বড় অংশ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, পতেঙ্গা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের পকেটে পাঠিয়ে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এসব ঝুঁপড়ি দোকানের কারণে ছুটির দিনে অবসাদ কাটাতে আসা লাখো পর্যটক পড়েন বিভ্রান্ততে। কেননা, পতেঙ্গা সৈকতে পর্যটদের জন্য ৩০ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ করলেও তাঁর পুরোটাই দীর্ঘদিন ধরে হকারদের দখলে। সিডিএ ও জেলা প্রশাসনের লোক দেখানো কিছু অভিযান থাকলেও তা নিতান্তই আইওয়াশ ছাড়া আর কিছু নয়।

জানা যায়, সৈকতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তালিকাভূক্ত দেড় শতাধিক দোকান থাকলেও এখন অবৈধভাবে আরও অন্তত পাঁচশ দোকান বসানো হয়েছে। দোকানিদের বেচাকেনা করতে দৈনিক ভিত্তিতে দিতে হয় চাঁদা। দোকান গুলোয় প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪২ লাখ টাকার চাঁদা তুলছে একটি চক্র, যা বছরে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার মতো।

এসব অবৈধ স্থাপনার করণে পর্যটকদের পা রাখার ঠাঁই নেই পতেঙ্গা সৈকতে। এসব অবৈধ স্থাপনা বসানোর নেপথ্যের কারিগর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। এ কমিটির কোন জনহিতকর কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মতো নেই। সৈকতের শৃঙ্খলা ফেরাতে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির মহাপরিকল্পনার নামে সৈকতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট উচ্ছেদ না করে, উল্টো স্থানান্তর করেই শৃঙ্খলা ফেরাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু তাও সফল হতে পারেননি।

সিডিএ সূত্র জানায়, সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ জোন-১ এবং জোন-২ এ বিভক্ত করা হয়েছে। জোন-১ এর অধীনে ৫ কিলোমিটার হাঁটাপথ, বয়স্ক ও শিশুদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র এবং কিডস জোন, বিভিন্ন ধরনের মেকানিক্যাল ও নন-মেকানিক্যাল রাইডের কাজ করেছিলেন। এছাড়া সুসজ্জিত বাগান এবং ক্যাবল কারের সংস্থান করা। এর সঙ্গে বোটিংয়ের জন্য জেটি ও কার পার্কিং। আলোকসজ্জার মাধ্যমে রাতের সমুদ্রদর্শনের জন্য নানা আয়োজন। জোন-২ অঞ্চলে সৌন্দর্যবর্ধন, হোটেল-মোটেল, আধুনিক মানসম্পন্ন প্লাজা, সুসজ্জিত বাগান এবং টয় ট্রেনের ব্যবস্থার কথা কাগজে কলমে বন্দি। ফলে, দখলদারদের কবলে পড়ে সেই সৌন্দর্য এখন ম্লান।

অভিযোগ আছে, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় পতেঙ্গা সৈকতে এসব অবৈধ স্থাপনা বসিয়েছে গুটিকয়েক প্রভাবশালীরা ব্যক্তি। এখান থেকে চাঁদা তোলে দুটি গ্রুপ। এর মধ্যে একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন ‘পতেঙ্গা সৈকত দোকান মালিক সমিতি’র নামে ওয়াহিদুল আলম ওরফে ওয়াহিদ মাস্টার, মাইনুল ইসলাম ও তাজু নামে ব্যক্তিরা। একইসঙ্গে ‘পতেঙ্গা সৈকত হকার্স সমিতি’র নামে টাকা তোলেন নুর ও শাহাব উদ্দিন।

জানা গেছে, পতেঙ্গা সৈকতে গড়ে ওঠা পাঁচ শতাধিক স্থাপনার প্রতিটি থেকে প্রাথমিকভাবে এককালীন চাঁদা নেয় স্থানীয় গ্রুপ দুটি। প্রতিটি স্থাপনা থেকে এ চাঁদার পরিমাণ দোকানভেদে ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা! এ হিসাবে এককালীন তোলা চাঁদার পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি।

এছাড়া প্রতিটি স্থাপনা থেকে দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে চাঁদা ওঠে প্রায় ২০ লাখ টাকা। চাঁদার এই টাকা দুগ্রুপের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। আবার এর বড় একটি অংশ যায় ডিসি, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, পতেঙ্গা সৈকত ট্যুরিস্ট পুলিশের পকেটে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানি জানান, গত ২০ বছর ধরে আমরা সি-বিচে (পতেঙ্গা সৈকত) ব্যবসা করছি। আগে কাউকে চাঁদা দিতে হয়নি। এখন দোকান করতে গেলে ওয়াহিদ মাস্টার গ্রুপ ও নুর মোহাম্মদ গ্রুপকে চাঁদা দিতে হয়। কয়েক বছর ধরে হকারদের কাছ থেকে এই দুগ্রুপ চাঁদাবাজি করে আসছে। তাদের টাকা না দিয়ে এখানে দোকান বসানো যায় না। সবাইকে এককালীন টাকা দিয়ে এখানে বসতে হয়। এছাড়া দোকানের আকারভেদে দিনে চাঁদা দিতে হয়। কখনো কখনো এক হকার থেকে দুগ্রুপই টাকা নিয়ে যায়।

দোকানিরা আরও জানান, এখানে দুটি সমিতির নাম ব্যবহার করা হলেও মূলত বেশির ভাগ টাকা যায় প্রশাসনসহ গুটিকয়েক মানুষের পকেটে। মনির নামে এক পর্যটক বলেন, ‘এক সময় সি-বিচে আসলে অনেক ভালো লাগতো। কিন্তু এখন মনে হয় কোনো গ্রামের মেলায় এসেছি। যে দিকে যাই, শুধু হকার আর দোকান। যেখানে পর্যটকের নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নে ভ্রমণ ও হাঁটা-চলা করা কঠিন। পরিবার পরিজন নিয়ে পতেঙ্গা বিচে ঘুরাফেরা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

ইকবাল হাসান নামে আরেক পর্যটন বলেন, এখানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কেন শত কোটি টাকা খরচ করলো বুঝলাম না। পর্যটকদের চলাচলের জন্য পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে ৩০ ফুটের মতো ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হলেও তা পর্যটকদের কোনো কাজে আসছে না। সি-বিচের পুরো ওয়াকওয়ে হকারদের দখলে। নিচে চলাচলে সামন্য একটু জায়গা থাকলেও, সেখানেও দেখছি দোকানদাররা চোয়ার বিছিয়ে দিয়েছে। কোথাও হাঁটার একটু জায়গা নেই।’

এদিকে দোকানিদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ওয়হিদুল আলম ওরফে ওয়াহিদ মাস্টার। তিনি বলেন, আমরা কারো কাছ থেকে চাঁদা নিই না। এখানে সবাই যার যার মতো দোকান নিয়ে বসেছে। সমিতির জন্য নাম মাত্র কিছু টাকা নেওয়া হয়।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হয়ে হকারদের কাছ থেকে ওয়াহিদ মাস্টার চাঁদা তোলেন—জানিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হকার সমিতির সভাপতি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘চাঁদাবাজি আমি করি না, করেন ওয়াহিদ মাস্টার। এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আমার তিনটি চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। আমরা সমিতির জন্য সামান্য টাকা নিই। মূলত এখানকার সব চাঁদাবাজিতে ওয়াহিদ মাস্টার জড়িত।

এ বিষয়ে পতেঙ্গা থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে বলেন, ‘থানায় এখন কোন কার্যক্রম নেই। আমিও নতুন। সুতরাং এ ধরনের কোনো অভিযোগের বিষয়ে আমি জানি না।’

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ এর মুঠোফোনে একধিকবার যোগাযোগের চেষ্ট করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘এখানে তালিকাভূক্ত দোকানির বাইরে সবাই অবৈধ। কারা বাণিজ্য করে চাদাঁবাজি করে আমি জানি না। এগুলো উচ্ছেদ করা হবে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান কিছুদিন আগে গণমাধ্যম কে জানান, ‘সৈকতে কোনো চাঁদাবাজি বা অবৈধ ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। দোকানিদের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। সেটিও হবে সৈকত থেকে দূরে। সৈকতের পাশে কোনো দোকান থাকবে না। সৈকত হবে উন্মুক্ত।’ কিন্তু জেলা প্রশাসকের কাজের সাথে পতেঙ্গা বিচের বাস্তব চিত্রের কোন মিল পাওয়া যায়নি।