চমেকের অপারেশন থিয়েটারে সুইপারের চমক! পরিচালকের হুঙ্কার
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের কাজ করছেন সুইপাররা। ওয়ার্ডের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালনের কথা যাদের তারাই রোগীকে অ্যানাসথেসিয়া দিচ্ছেন, অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) ডাক্তারের সহযোগী হচ্ছেন, কাজ ফেলে বসছেন টিকিট কাউন্টারে।
অনেকে ওটি থেকে রোগীর অব্যবহৃত সুতা, গজ, ব্যান্ডেজ চুরি করে বিক্রিও করে ফেলেন পূর্ব গেট এলাকার ফার্মেসিগুলোতে। সুইপারের চাকরিকে তারা অসম্মানের মনে করেন। ফলে নিজেরাই নিয়োগ দেন আয়া। এসব আয়া সেবা দেওয়ার নাম করে দিন-রাত পকেট কাটছে রোগীর স্বজনদের।
তবে এসব বিষয় জানার পরও চুপ আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক। জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে এই প্রতিবেদককে ‘দুই টাকার সাংবাদিক’ হিসেবে সম্বোধন করেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়োগপ্রাপ্ত ৯৯ জন সুইপার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু তারা কাজ না করায় মেডিকেল ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ওয়ার্ডে ও ওয়ার্ডের বাইরে এবং টয়লেটে যাওয়ার পরিবেশ নেই।
মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডের ওটিতে সকাল ও বিকালের শিফটে কাজ করেন কয়েকজন সুইপার। পরিচ্ছন্নতার কাজ বাদ দিয়ে তারা করেন ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে সার্জারির কাজ। বলতে গেলে ডাক্তারদের অর্ধেক কাজ তারাই করেন। রোগীকে অজ্ঞান থেকে শুরু করে সেলাইও করেন।
তাদেরই একজন সার্জারি ইউনিটে সকালের শিফটের সুইপার রামকৃষ্ণ তালুকদার। কিন্তু এই রামকৃষ্ণ অপারেশনের যাবতীয় কিছু রোগীর স্বজনের মাধ্যমে কিনে আনেন। ওটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকেন তিনি। কোনো সুতা, গজ, ব্যান্ডেজ বেচে গেলে তিনি তা চুরি করে বেচে দেন পাশের ফার্মেসিগুলোতে। কয়েকবার তিনি ওষুধ পাচার করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন।
এছাড়া সার্জারির ওটিতে বিকালের শিফটে থাকেন উজ্জ্বল দাশ। তিনিও ওটির ক্লিনিংয়ের কাজ বাদ দিয়ে ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে থাকেন। সার্জারিতে সকালের শিফটের আরেক সুইপার গোলাম রাব্বীও একই দলে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সুইপার আব্দুল খালেক এখন ওয়ার্ডবয়। অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডের মিনি অপোরেশন থিয়েটার তিনিই পরিচালনা করেন।
গাইনি ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে সিজারিয়ান অপারেশনে রোগীদের অজ্ঞান করতে ডাক্তারদের সহযোগী হিসেবে থাকেন সুইপার বিপ্লব ঘোষ। ১৮ নম্বর নিউরো মেডিসিন ওয়ার্ডের সুইপার দায়িত্ব পালন করেন সর্দারের। এছাড়া ৩৩ নম্বরের সুইপার মীর আলীও এখন সর্দার। বর্তমানে তিনি প্রশাসন ভবনের আটতলাতে দায়িত্ব পালন করছেন।
এমন আরও ২০ থেকে ২৫ জন সুইপার মেডিকেলের আউটডোরে টিকিট বিক্রির কাজে নিয়োজিত আছেন। আউটডোর ছাড়া এক্স-রে ওয়ার্ডে কাজ করেন পাঁচ থেকে সাতজন সুইপার। আর ওয়ার্ডবয় হিসেবে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন ৩০ থেকে ৩৫ জন সুইপার। সর্দার হিসেবে রয়েছেন ১৮ থেকে ২০ জন। সুইপারদের একটা বড় অংশ দায়িত্ব পালন করেন মেডিকেল স্টোরে।
এসব সুইপাররা নিজেরাই আবার নিয়োগ দিয়েছেন আয়া। এসব আয়া মেডিকেল থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত না হলেও অনায়াসে প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে। আর বকশিসের নামে ইচ্ছেমতো রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। তাদের টাকা না দিলে পরিষ্কারও করেন না ঠিকমতো। ফলে চারদিকে ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। নিরুপায় হয়ে টয়লেটের সামনে বর্জ্য ফেলে রাখেন রোগী ও স্বজনরা। এতে ওয়ার্ডে ময়লার দুর্গন্ধে থাকা দায় হয়ে পড়ে রোগীদের।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে কাজ করা ১০ থেকে ১২ জন আয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। এদিকে রোগীকে অপারেশনের আগে অ্যানাসথেসিয়া দিয়ে অচেতন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকেন অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার কোনো ডাক্তার। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলের নাক, কান ও গলার (ইএনটি) ওটিতে অ্যানাসথেসিয়া দেন সুইপার রাজু মজুমদার। সেইসঙ্গে অপারেশনের পর অবশিষ্ট ওষুধ রোগীদের ফেরত না দিয়ে বাইরের দোকানে বিক্রি করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া কথায় কথায় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করেন ‘বকশিস’। তাকে বকশিস না দিলে সেবা মেলে না রোগীদের।
অথচ অ্যানাসথেসিয়ার সময় কোন অঙ্গ অবশ করতে কতটুকু ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়, সেটা কেবল ডাক্তার ঠিক করেন। এই কাজে কোনোভাবেই ওয়ার্ডবয় থাকতে পারেন না বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেলের অ্যানাসথেসিয়া বিভাগের প্রধান ডা. মো. হারুনুর রশিদ।
আরও জানা গেছে, ইএনটির ওটিতে ডাক্তারদের সঙ্গে থাকেন অফিস সহায়ক মামুন হাসান। তবে তিনি অফিসে অনুপস্থিত থাকলে তার কাজ করেন রাজু মজুমদার। অথচ ডাক্তারদের সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ছাড়া কোনো অফিস সহায়ক বা সুইপারের ওটিতে থাকার নিয়ম নেই। এছাড়া ওটির যাবতীয় যন্ত্রপাতির সেটআপও করে থাকেন মামুন এবং রাজু।
অভিযোগের বিষয়ে সুইপার রাজু মজুমদার বলেন, ‘আমি সুইপার হলেও ওটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। ডাক্তার স্যারদের সঙ্গে থেকে রোগীকে অজ্ঞানের কাজে আমাকে সহযোগিতা করতে হয়।’
সুইপাররা পরিচ্ছন্নতার কাজ বাদ দিয়ে ওটিতে ডাক্তারদের সঙ্গে থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘মেডিকেলে জনবল সংকট রয়েছে। আর সুইপার যদি অন্য ভালো কোনো কাজের যোগ্য হয়, দিতে অসুবিধা কী? কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনো জায়গায় নিয়োগ দিতে পারে।’
এই সময় তিনি এই প্রতিবেদককে কটাক্ষ করে বলেন, ‘আপনাদের মত দুই টাকার সাংবাদিক হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট বুঝবে না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমাকে এত রোগী সামাল দিতে হয়, প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন