চলতি জুনেই দৃশ্যমান হচ্ছে পদ্মা সেতু
পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ। এরই মধ্যে দেশের অন্যতম এই মেগা প্রকল্পের ৪৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে।
সেতুর প্রথম পিলারের ওপরের অংশে জাজিরা প্রান্তের ৩৭ নম্বর পিলারের ঢালাই হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরেকটি পিলারের ঢালাই হলে উঠে দাঁড়াবে সুপারস্ট্রাকচার (স্প্যান)। ফলে চলতি জুন মাসেই দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে স্বপ্নের এ সেতু।
৩৭ নম্বর পিলার ঢালাইয়ের মধ্য দিয়ে সেতুর প্রথম পাইল তৈরি সম্পন্ন হচ্ছে। আগামী রোববার, ১৮ জুন ঢালাই হবে ৩৮ নম্বর পিলার। এটির রড বাইন্ডিংয়ের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই দুই পিলার সম্পন্ন হওয়ায় পরই প্রথম স্প্যানটি (সুপারস্ট্রাকচার) সেতুর ওপর বসানো হবে।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, দুই পাড়ে ১২টি করে ২৪টি পিলার ছাড়াও ৪২টি মূল পিলারের ওপর ৪১টি সুপারস্ট্রাকচার বসবে। এর মধ্যে ২০টি স্ট্রাকচার তৈরি হয়ে গেছে। বাকিগুলো তৈরির কাজ চলছে চীনের সাংহাই শহরের সিং হোয়াং দাও কারখানায়। তৈরি অবস্থাতেই এগুলো বাংলাদেশে আনা হবে।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে দেশের অন্য জেলাগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সরকারের ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে এক নম্বরে থাকা এ প্রকল্পটির কাজে যেন কোনো অনিয়ম না হয় সেদিকে নজর রাখছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই যাতে সেতুটি বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকই খেয়াল রাখা হচ্ছে। সে হিসেবে ২০১৯ সাল নয় ২০১৮ সালের মধ্যে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
পদ্মা সেতুর কাজের জন্য ৩ হাজার ৬০০ কিলোজুল ক্ষমতার (বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার) হ্যামার এখন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে জাজিরা প্রান্তে এর ফিটিংয়ের কাজ করা হয়েছে। এটি এখন ব্যবহার উপযোগী। আজ প্রথমবার বিশাল হ্যামারটি ৪১ নম্বর পিলারের পাইল ড্রাইভ করবে। এই পিলারে চারটি পাইল স্থাপন হলেও বাকি রয়েছে আরো দুটি। এই হ্যামার এখানে বাকি পাইলগুলো স্থাপন করবে।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, মাওয়া প্রান্তের ১৩ ও ১৪ নম্বর পিলারের কাজ শুরু হয়েছে ১০ জুন। ২ হাজার ৪০০ কিলোজুল ক্ষমতার পুরোনো হ্যামারে এই পাইল ড্রাইভ হচ্ছে। এ ছাড়া পুরনো নেদারল্যান্ডসের ২ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটিও মেরামত হয়েছে।
পদ্মা সেতু এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মার দুই পাড় মাওয়া, জাজিরা ও শিবচরে কর্মযজ্ঞ চলছে। মাওয়ায় বড় বড় ক্রেন দিয়ে টেস্ট পাইল বসানোর কাজ চলছে। মাওয়ায় পদ্মার পাড়ে বড় বড় পাইপসহ বিভিন্ন ভারী যন্ত্রপাতির স্তূপ পড়ে আছে। নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। বড় বড় যন্ত্রে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। নির্মাণ অঙ্গনে (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের থাকার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে ঘর বানানো হচ্ছে। কয়েকশ’ শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন।
পদ্মায় এ পর্যন্ত ৬০টি পাইল স্থাপন হয়েছে। আর তীরের আরো ১৬টি। সব মিলিয়ে মূল সেতুর ৭৬টি পাইল স্থাপন হয়েছে। এ ছাড়া জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সেতুর পাইল স্থাপন হয়েছে ১১৩টি।
গত শুক্রবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেতু কর্মযজ্ঞ পরিদর্শন করে গেছেন। তখন তিনি বলেছেন, সেতু যথাসময়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার সব রকম প্রচেষ্টা চলছে। আর নতুন হ্যামার সংযুক্ত হওয়ায় কাজের গতি আরো বেড়ে গেছে।
সেতুর স্প্যান ফিটিংয়ের কাজ চলছে দ্রুততর সঙ্গে। পদ্মা সেতুর মোট ৪১টি স্প্যান প্রয়োজন। এগুলোকে ৭টি মডিউলে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি মডিউলে ‘এ’ থেকে ‘এফ’ পর্যন্ত ছয়টি করে। তবে ৭ নম্বর মডিউলে শুধু ‘ডি’ নেই। তাই ৭ নম্বর মডিউলের ৫টি স্প্যান। এই ৫টি স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) ইতোমধ্যেই মাওয়া পৌঁছে গেছে। এ ছাড়া ১ নম্বর মডিউলের ‘এফ’ আগেই এসে পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে ৮টি স্প্যান এখন মাওয়ার কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডে। এর মধ্যে ২টি জোড়া লাগানো সম্পন্ন হয়েছে। আরো তিনটি স্প্যানের জোড়া লাগানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। ৪১টি স্প্যানের মধ্যে সবগুলোই তৈরি করা হচ্ছে চীনে। এগুলোর এক একটি স্প্যানের ওজন প্রায় ৩ হাজার টন। তাই খণ্ড খণ্ড আকারে মাদার ভার্সেলে করে সমুদ্রপথে চীন থেকে আনা হচ্ছে। এই স্প্যানের ২০টি তৈরি করা হয়ে গেছে। আরো ৮টি তৈরির কাজ চীনে চলছে এখন। ২০ স্প্যান স্থাপন করতে করতে বাকি ২১টি স্প্যানও তৈরি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্টের ১৯৩ পাইলের মধ্যে ১১৩তম পাইলটি স্থাপন হয়েছে গত শুক্রবার। মাওয়া প্রান্তের কাজ শুরু হবে। মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টের ৩৭টি পিয়ারের মধ্যে ১৭২টি পিলার। এর মধ্যে ১৭টি পিলারের ৬৬টি পিলারের অনুমোদন মিলিছে। পাইলগুলোর গভীরতা প্রায় ৭০ থেকে প্রায় ৮০ মিটার পর্যন্ত। জাজিরা প্রান্তের নদীর মাঝের ৪০টি পিলারের ২৪০টি ও দুই পারে ২টি পিলারের ২৮টিসহ মূল সেতুর মোট ২৬৮টি পাইল স্থান করা হচ্ছে। এ ছাড়া দেড় কিলোমিটার করে উভয় প্রান্তে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) জন্য আরো হচ্ছে ৩৬৫টি পাইল। এর মধ্যে মাওয়া অংশে ১৭২ এবং জাজিরা অংশে ১৯৩টি পাইল রয়েছে।
সেতুর জন্য মোট ২৪০টি টিউব প্রয়োজন যার মধ্যে ১৯২টি টিউব তৈরি হয়েছে। বাকিগুলো তৈরির কাজ চলছে। সেতু নির্মাণযজ্ঞে এখানে বিরাজ করছে বিশেষ পরিবেশ।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরুর সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব শুরু হয়েছে। পদ্মার দুই পাড়ে নির্মাণাধীন সংযোগ সড়কে দেশীয় ইট, পাথর ও বালুসহ নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। পদ্মার দুই পাড়ে অবস্থিত তিন জেলা মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে উন্নয়নের ধারা শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা আধুনিক শহর গড়ে উঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এ ছাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দেড় হাজার পরিবার প্লট পেয়েছেন। গ্রাম এলাকায় অবস্থিত এসব আধুনিক শহরের সুবিধা ভোগ করছেন তারা।
এদিকে, এরই মধ্যে মাত্র দুই বছরে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড। মাদারীপুর পাঁচ্চর থেকে শরীয়তপুরের নাওডোবা পর্যন্ত এই সড়কের দৈর্ঘ্য সাড়ে ১০ কিলোমিটারের বেশি। পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক চালু হওয়ায় নৌ-পথের দূরত্ব আট কিলোমিটারের বেশি কমে গেছে। একই সঙ্গে এক ঘণ্টারও কম সময়ে লঞ্চ বা ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিতে পারছেন যাত্রীরা। আগে যেখানে দেড় থেকে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগত। এখন সেখানে স্পিডবোটে সময় লাগছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন