চামড়ার দাম তলানিতে, তবু জুতো কেন এত দামি?
বাংলাদেশে এ বছর পশুর কাঁচা চামড়ার দাম গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা বলছেন। কিন্তু চামড়ার এতোটা দাম কমলেও জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগের মতো চামড়া জাত পণ্যের মূল্য এখনো চড়া রয়েছে, তার দাম কমার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।
কেন কাঁচামালের দরপতনের পরেও এসব পণ্যের এতো চড়া দাম?
ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা শিখা রহমান দেশে তৈরি চামড়ার পণ্য ব্যবহার করতেই পছন্দ করেন। কিন্তু তিনি বলছেন, যখন কোরবানির চামড়া প্রায় পানির দরেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, তখনো দোকান থেকে চামড়ার পণ্য কিনতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে।
শিখা বলছেন, ”কিছুদিন আগে কোরবানির গরুর চামড়াটা বিক্রি করতে হল মাত্র তিনশো টাকায়। এর বেশি কেউ দাম দেবে না। কিন্তু এর আগে যখন দোকান থেকে জুতা-স্যান্ডেল কিনেছি, কোনটাই চার-পাঁচ হাজার টাকার নিচে কিনতে পারিনি। এখনো পারছি না। তাহলে এতো সস্তায় চামড়া কিনে, সেটা দিয়ে জিনিসপত্র বানিয়ে এতো বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে কেন? একজন ক্রেতা হিসাবে আমার তো মনে হচ্ছে আমি বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।”
ঢাকায় বর্তমানে ভালো একটি দোকানে চামড়া দিয়ে তৈরি একজোড়া জুতার দাম তিন থেকে আট হাজার টাকা।
কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি পণ্যের দামের এতো পার্থক্যের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
আতিক রহমান লিখেছেন, ”তিনশো টাকার চামড়ার জিনিস কিনছি ছয় হাজার টাকা দিয়ে! এ কেমন ব্যবসা?”
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী লিখেছেন, ”গত পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত চামড়ার দাম কমলেও, জুতার কিন্তু বেড়েই চলেছে। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতোই। পশুর ক্রয়মূল্যের সঙ্গে তার চামড়ার দামের সামঞ্জস্য নেই। আবার চামড়ার সঙ্গে জুতার বিক্রির মূল্যের সঙ্গতি নেই।”
এ বছর কোরবানির সময় প্রতি বর্গফুট কাচা চামড়ার মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৫ টাকায়, ঢাকার বাইরে ৩৫টাকা। অর্থাৎ একেকটি গরুর চামড়া হাতবদল হয়েছে তিনশো থেকে আটশো টাকার মধ্যে।
ট্যানারি মালিকরা এবার সরকারি দামেই চামড়া কেনার কথা জানিয়েছেন। এর ত্রিশ শতাংশ অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহৃত হয়। কারখানায় প্রক্রিয়ার পরে এসব চামড়া দিয়ে জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ বা জ্যাকেট তৈরি করা হয়ে থাকে। কিন্তু চামড়ার এমন দরপতনের পরেও এসব পণ্যের দাম এতোটা চরা কেন?
বাংলাদেশের ফিনিশড লেদার ও লেদার সামগ্রী প্রস্ততকারক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। বলছেন, “কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি হওয়া পণ্যের দাম মেলানো যাবে না। বিশেষ করে চামড়ার মতো কাঁচামাল অনেক হাত ঘুরে আমাদের কাছে আসে। এখন যে চামড়াটা আপনি তিনশো টাকায় বিক্রি হয়েছে বলছেন, সেটা কিন্তু আমাদের কাছে তখন সেটা দর অনেক বেড়ে যায়। আমরা সরকারি রেট অনুযায়ীই কিনছি।”
এর সঙ্গে সেটাকে প্রসেস করার, কারখানার, শ্রমিক খরচ যোগ হবে বলে তিনি বলছেন।
”এরপর সেই প্রসেসড চামড়াটা আরেকজন কিনে নিয়ে দেশী বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার মতো সেটা দিয়ে জুতা, স্যান্ডেল বা ব্যাগ তৈরি করবে। তার কাছ থেকে সেসব ব্রান্ড এসব পণ্য কিনে নিয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করে। কারণ আন্তর্জাতিকভাবেই মনে করা হয়, কয়েকগুণ বেশি দাম না ধরা হলে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। ”
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ”একজোড়া জুতা বিদেশে রপ্তানি করা হয় হয়তো ১৪ বা ১৬ ডলারে, কিন্তু সেটাই হয়তো বায়ার তার দোকানে বিক্রি করছে ৮০ বা একশো ডলারে।”
সেখানেও তাদের অনেক খরচ রয়েছে বলে তিনি বলছেন। বিজ্ঞাপন, দোকানের খরচ, কর্মী ব্যয় এবং অনেক সময় জুতা বা পণ্য অবিক্রীত থেকে যায়, এসব খরচও সেখানে যোগ হয়।
তৈরি পোশাকসহ এ ধরণের সব ব্যবসাতেই এ ধরণের নিয়ম অনুসরণ করা হয় বলে তিনি বলছেন।
বাংলাদেশে এখন প্রায় দেড় বিলিয়ন কোটি টাকার চামড়া পণ্যের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি।
কোম্পানি ভেদে পণ্যের মূল্যে রকমফের থাকলেও, তাদের কারো পণ্যেই কাঁচামালের এই দরপতনের প্রভাব দেখা যায়নি। এ নিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোয় ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু কাঁচামালের মূল্য কমলে তো এসব পণ্যেরও খুচরা বিক্রয় মূল্য কমার কথা।
সে প্রসঙ্গে মি. আহমেদ বলছেন, ”এবার যে কম দামের চামড়ার কথা বলা হচ্ছে, ক্রেতারা যখন আমাদের অর্ডার দিতে আসবেন, তারাও আমাদের কম টাকা দিতে চাইবেন। হয়তো এসব কমের প্রভাব পরবর্তীতে বাজারে দেখা যেতে পারে।”
গবেষকরা বলছেন, কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবসময়েই পার্থক্য থাকবে। কিন্তু সেটা যৌক্তিক হচ্ছে কিনা, বাংলাদেশে সেরকম নজরদারি নেই।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, বাংলাদেশের বাজারে একবার কোন পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীরা তা আর কমাতে চান না।
তিনি বলছেন, ”যখন কোন পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়, তখন শুধু কাঁচামাল নয়, অনেক কিছু বিষয় বিবেচনা করেই সেটির দাম নির্ধারিত হয়। যেমন কারখানার ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, শ্রমিক বেতন ইত্যাদি থাকে। কাঁচামালের দাম কমলেও সেগুলো তো কমেনি।”
”আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশের বাজারে একটি পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে, বাজারের অন্যান্য খরচ কমলেও সেটার দাম আর কমে না। আমাদের ভোক্তাদের অধিকার না থাকার কারণে পণ্যের উৎপাদকরা যে দাম নির্ধারণ করেন, সেটাই গ্রহণ করতে হয়। তাদের উৎপাদন খরচ কমলো কিনা, সেটা আর যাচাই করা হয় না। সেটা শুধুমাত্র চামড়া জাত পণ্যই নয়, অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে।
ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ”যখন কোন পণ্যের উপাদানের দাম কমে যায়, ওই পণ্যটিরও দাম কমা উচিত। এখানে চামড়ার কাঁচামালের দাম কমলেও, তৈরি পণ্যের যে দাম কমছে না, এক্ষেত্রে একটি সঙ্গতির অভাব রয়েছে।”
ভোক্তারা তাদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হলে আর ভোক্তা অধিকার আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই পার্থক্য কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন