চুয়াডাঙ্গায় দুর্নীতিবাজদের হস্তক্ষেপে বিএডিসি বীজ সরবরাহ বন্ধ: ধান উৎপাদনে শঙ্কা
চুয়াডাঙ্গায় বিএডিসি ধান বীজ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে চারদিন। শুধু চুয়াডাঙ্গাই নয় মেহেরপুর ও কুুষ্টিয়া জেলার শত শত ডিলাররা বীজ উত্তোলন করতে পারছে না বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র থেকে।
এতে করে চুয়াডাঙ্গা জেলার ডিলারদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরী হয়েছে সংশ্লিষ্ট অফিসের দুই কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ডিলারদের ওপর। ফলে বীজ সরবরাহ বন্ধ থাকায় কৃষকরাও পড়েছেন বিপাকে। ফলে ধান উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ধান চালের এই বৈশ্বিক সময়ের মধ্যেও প্রভাবশালী ডিলার রাজনৈতিক ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারদের কারণেই বেশিরভাগ সময়ই এমন ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। এতে করে সাধারণ ডিলাররা বীজ কিনতে না পেরে যেমন ব্যবসায়ীকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনী ধান উৎপাদনে সঙ্কট দেখা দেবে চুয়াডাঙ্গা জেলায়। এতে করে ভোক্তাপর্যায়ের কপালে পড়েছে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ। এসব বীজ সিণ্ডিকেটদের কারণেই কৃষকদের যেমন বেশি দামে বীজ কিনতে হয় তেমনী ভোক্তাদেরও বেশি দামে চাল কিনতে হিমশিম খেতে হয় সবসময়।
তবে অভিযোগ উঠেছে চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় যুবলীগ নেতাকর্মীদের বাধার কারণেই নাকী ধান বীজ সংগ্রহ করতে পারছেন না সাধারণ ডিলাররা। এর নেপথ্যে বিএডিসির দুই কর্মকর্তার যোগসাজশ প্রভাবশালী ডিলারদের প্রভাবসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অদৃশ্য হুমকির ধামকি রয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা বিএডিসি’র বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের যুগ্ম পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই। বাধার কারণে কোনো শ্রমিক কাজ করছেন না। এতে ডিলারদের মাঝে ধান বীজ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।’
বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ বিতরণ বর্ষে বিএডিসি’র কুষ্টিয়া বিপণন ও চুয়াডাঙ্গা বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের প্রায় তিন হাজার টন বোরো ধান বীজ পুনঃনির্ধারিত দামে বিক্রির অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ। গত ১১ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি চিঠি আঞ্চলিক বিপণন কার্যালয়ে পাঠিয়ে শর্তসাপেক্ষে ধান বীজ বিক্রয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে ব্রি-২৮ ধানসহ সব চিকন জাতের ধান বীজের দাম প্রতি কেজি ৩৮ টাকা ও ব্রি-২৯ ধান বীজসহ মাঝারি চিকন জাত ৩৭ টাকা এবং সব মোটা জাতের ধান বীজ ৩৫ টাকা দাম নির্ধারণ করে বিধি মোতাবেক ডিলারদের মাঝে পুনরায় বরাদ্দ করতে বলা হয়েছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, যেসব ডিলার বীজ সহায়তা দরে বোরো ধান বীজসহ অন্যান্য বীজ উত্তোলন করেছেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিএডিসি’র একটি সূত্র জানায়, এমন নির্দেশনা না মেনে বিএডিসি’র দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পুনঃনির্ধারিত দামের ১ হাজার ১শ টন ধান বীজ সালাউদ্দিন নামে চুয়াডাঙ্গার এক প্রভাবশালী এক ডিলারকে দিতে কুষ্টিয়া অফিসে চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে বীজ সহায়তা দরে বোরো ধান বীজসহ অন্যান্য বীজ উত্তোলনকারী ডিলারদের মধ্যে পুনঃনির্ধারিত দামের ধান বীজ বরাদ্দ দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী ডিলার সালাউদ্দিনসহ বিএডিসি’র ওই দুই কর্মকর্তা। সর্বশেষ চাপের মুখে ডিলারদের বরাদ্দ করা ধান বীজ কর্তন করে ওই ডিলারকে ৬৬০ টন ধান বীজ দিতে বাধ্য হয় কুষ্টিয়া বিপণন কার্যালয়। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট হননি বিএডিসি’র ওই দুই কর্মকর্তা। বাকি ৪৪০ টন ধান বীজ পাইয়ে দিতে নানা পাঁয়তারা চালাতে থাকে। গত বুধবার সকালে বিএডিসি’র বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে ডিলারদের একাধিক ট্রাক আটকে দেয়াও হয়। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় পুনঃনির্ধারিত দামের ধান বীজ উত্তোলন।
ডিলারদের অভিযোগ, চলতি বছর এই অঞ্চলে বিএডিসি’র গম বীজ চরম সংকট সৃষ্টির পেছনে বিএডিসি’র দুই কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। বরাদ্দ হওয়া বীজ ডিলারদের না দিয়ে প্রায় আড়াইশ টন গম বীজ সালাউদ্দিন ডিলারকে দিয়ে অধিক দামে কালোবাজারে বিক্রি করিয়েছেন। যে কারণে এই অঞ্চলে গম বীজের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
মেহেরপুর জেলার বীজ ডিলার আরমান আলী বলেন, আমি বিএডিসি’র সব বীজ সর্বোচ্চ পরিমাণ বিক্রি করি। অথচ বরাদ্দ দেয়ার সময় লাভজনক বীজ একজন অব্যবসায়ী ডিলারকে বেশি দেয়া হয়। এর সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। সর্বশেষ বীজ সহায়তা দরে বোরো ধান বীজ উত্তোলনের আনুপাতিক হারে আমার নামে পুনর্র্নিধারিত দামের ধান বীজ বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দ করা ওই ধান বীজের পে-অর্ডার কুষ্টিয়া বিপণন দপ্তরে জমা দিয়ে মেমো কেটে চুয়াডাঙ্গা বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে উত্তোলন করতে যাই। সকালে আমার ট্রাকে ধান বীজ লোড করতে গেলে বিএডিসি’র কর্মকর্তারা জানান, কোনো ধান বীজ দেয়া যাবে না। যুবলীগের নেতারা বীজ দিতে নিষেধ করেছেন।
চুয়াডাঙ্গা বিএডিসি’র বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের যুগ্ম পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম জোয়ার্দ্দার পুনঃনির্ধারিত দামের ধান বীজ ডিলারদের দিতে নিষেধ করেছেন। এখানকার লেবাররাও তাদের নিয়ন্ত্রিত। নিষেধ করায় লেবারও কাজ করছেন না। এতে চারদিন ধরে পুনঃনির্ধারিত দামের ধান বীজ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
এ ব্যাপারে নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘আমি ধান বীজ উত্তোলনে বাধা দেইনি। আমি বলেছি, চুয়াডাঙ্গার ডিলাররা বীজ কম পেয়েছে। যেটা ভালো হয় সবাই মিলে সমাধান করে ধান উত্তোলন করেন।’
কুষ্টিয়া জেলা বিএডিসি বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জুবায়েদ রিপন বলেন, কৃষি ভবনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার সিণ্ডিকেটের কারণে সারা দেশে ডিলারদের ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সারা দেশে আঞ্চলিক কার্যালয়ে ওই দুই কর্মকর্তার মনোনীত একজন করে ডিলার রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে শক্তিশালী সিণ্ডিকেট তৈরি করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন দুই কর্মকর্তা।
কুষ্টিয়া বিএডিসি বীজ বিপণন কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবদুর রহমান বলেন, আমাদের কোনো চাপ নেই। যেসব ডিলার বীজ সহায়তা দরে বোরো ধান বীজসহ অন্যান্য বীজ উত্তোলন করেছেন তাদের মাঝেই পুনঃনির্ধারিত দরে ধান বীজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে চুয়াডাঙ্গা থেকে ধান উত্তোলনে বাধা দেয়া হয়েছে বলে শুনেছি।
বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করা হবে। তবে এ ব্যাপারে আপডেট জানতে সরকারী নাম্বারে একাধিকবার ফোন দেয়া হলে রিসিভ করেননি তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন