‘ছেলেকে বাঁচাতে নিজের কিডনি দিয়েছি, প্রয়োজনে জীবনও দিতে পারি’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজমুস সাকিব। হেসে-খেলে বেড়ান ক্যাম্পাসে। জীবন নিয়ে কত স্বপ্ন। হঠাৎ একদিন হলেন গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসকেরা জানালেন, তাঁর দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। জীবনের সব হিসাব এলোমেলো হয়ে গেল সাকিবের। তাঁর চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে এগিয়ে এলেন বন্ধুরা। কিন্তু কিডনি দেবে কে? এগিয়ে এলেন তাঁর জন্মদাতা পিতা।
বাবা। দুই অক্ষরের একটি ছোট্ট শব্দ। উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মনে আসে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। শত দুঃখ-কষ্ট আগলে বটবৃক্ষের মতো আশ্রয় হয়ে থাকেন বাবা। বাবার সঙ্গে হাঁটি হাঁটি পায়ে বড় হয় ছেলে। কঠোর পরিশ্রম করে ছেলেকে বড় করেন। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর সন্তান হুমায়ুনের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেননি।
আজকের দিনেও বাবারা জীবনের সবটুকু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন সন্তানের জন্য। নাজমুস সাকিব, মাসুদ রহমান, কামরুল হাসান—এই তিনজন সেটা খুব ভালো করেই জানেন। তাঁরা তিনজন আলাদা মানুষ হলেও জীবনের গল্প তাঁদের একই রকম। কারণ, তাঁদের আজকের যে দ্বিতীয় জীবন, সেটা তাঁদের নিজ নিজ বাবার কারণেই। তিনজনের বাবাই ছেলেকে বাঁচাতে দিয়েছেন কিডনি। তিনজনই বাবার কিডনি নিয়ে বেঁচে আছেন, এগিয়ে চলেছেন জীবনের পথে। লিখেছেন শরিফুল হাসান
‘হামার ছেলেক মরতে দেইনি’
উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে বাড়ি আবদুল গফুরের। লেখাপড়া খুব একটা করেননি। ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চালের দোকান আছে তাঁর। পাঁচ সন্তান গফুরের। তাঁদেরই একজন কামরুল হাসান। তাঁর আদরের এই ছেলে ১৬ বছর আগে কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। কী করবেন দিশা খুঁজে পান না গফুর।
সব সহায়সম্বল বিক্রি করে, ঋণ করে টাকা জোগাড় করলেন। এরপর গেলেন ভারতের বেঙ্গালুরুতে। তাঁর একটা কিডনি প্রতিস্থাপিত হলো ছেলের শরীরে। কামরুল এখন বাবার সঙ্গেই দোকানে কাজ করেন। ‘হামার ছেলেক মরতে দেইনি। হামি ওকে হামার সাথেই থুইছি।
ছোয়ালডাক দেকলেই মুই শান্তি পাই’, মুঠোফোনে বললেন আবদুল গফুর। পৃথিবীর সব বাবাই হয়তো সন্তানকে কোলে নিয়ে কিংবা সন্তানের কথা ভেবেই এমন শান্তি পান। আর সে কারণেই বোধ হয় জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে খারাপ মানুষ অনেক আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।’
বাবা আমাকে নতুন জীবন দিলেন:
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে বাড়ি মাসুদ রহমানের। বাবা কৃষক। কিন্তু পাঁচ ছেলেকেই লেখাপড়া করিয়েছেন। ছোট ছেলে মাসুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করলেন। ৩৩তম বিসিএস ক্যাডারে যোগ দিয়ে মাসুদ এখন যশোরের এম এম সরকারি কলেজের শিক্ষক। ২০০৭ সালে মা হারানো মাসুদের জীবনের গতি থেমে যেতে পারত ২০১৫ সালেই।
সেই সময়ের কথা বলেন মাসুদ রহমান, ‘২০১৫ সালের ডিসেম্বর। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেলাম। ঢাকায় কিডনি হাসপাতালে যাওয়ার পর জানলাম, আমার দুটো কিডনিই নষ্ট। বিসিএস ক্যাডার হয়েছি। কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছি। জীবনের এমন পর্যায়ে এসে সব এলোমেলো হয়ে গেল। কিন্তু নির্ভরতা হয়ে এলেন বাবা। তিনি আমাকে নতুন জীবন দিলেন। কিডনি হাসপাতালেই সব হলো। আমি এখন সন্তানের পিতা।
আমি পিতা হয়েছি বলেই বাবার ভালোবাসাটা বুঝি। এই ভালোবাসা বলে শেষ করবার নয়।’ মাসুদের বাবা আবদুর রহমান বললেন, ‘আমার ছেলেরে আমি খুব ভালোবাসি। আমি আমার ছেলেকে বাঁচাতে নিজের কিডনি দিয়েছি, প্রয়োজনে জীবনও দিতে পারি’। ছেলেটা আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, এতেই আমার শান্তি।’
বাবার কারণে আবার ক্লাসে:
নাজমুস সাকিবের জীবনে প্রতিটি দিনই বাবা দিবস। কারণ, বাবার কারণেই যে তিনি বেঁচে আছেন। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করেন সাকিব। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে জানতে পারেন, তাঁর দুটো কিডনিই নষ্ট। কিন্তু বাবার কল্যাণে আবার ক্লাসে যাচ্ছেন সাকিব। বাবার এমন দানকে কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে নাজমুস সাকিব বলেন, ‘কিছু কিছু অনুভূতি প্রকাশ করার নয়। এটা তেমনই অনুভূতি। আমার ভেতরে বাবা আছেন। বাবার কারণে আমি আছি।’
সাকিবের বাড়ি রংপুরে। তাঁরা তিন ভাইবোন। বাবা কায়সার আলী অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। সন্তানকে কিডনি দিয়ে নতুন করে জীবনদানের অনুভূতি কেমন? কায়সার আলী বললেন, ‘আমার ছেলেটা সুস্থ আছে। বেঁচে আছে। লেখাপড়া করছে। এগুলোই আমার সুখ। আমি চাই, ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করে ও শিক্ষকতা করুক।’ শিক্ষকতা কেন? মুঠোফোনের ওপাশ থেকে হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি চাই ও ভারী কাজ না করুক।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন