ছয় মাসে মিয়ানমারের ৯০ ভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’-এ প্রায় ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। গত আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরুর আগে সেখানে ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮ জন রোহিঙ্গা ছিল। বর্তমানে রাখাইনে মাত্র ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৭৯ হাজার ৩৮ জন রোহিঙ্গা রয়েছেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সমন্বয়ক সংস্থা (ইউএনওসিএইচএ) ও রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিয়ানমারের স্থানীয় দৈনিক দি ইরাবতি এক প্রতিবেদনে শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
দি ইরাবতি বলছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর হামলার পর রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত মংডু, বুথিডং ও রাথেডং শহর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর ধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ করছেন। মংডু, বুথিডং ও রাথেডং শহরের সাধারণ প্রশাসনিক বিভাগ (জিএডি) ও ইউএনওসিএইচএর সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিসংখ্যান তৈরি করেছে ইরাবতি। মিয়ানমারের সেনা নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে জিএডি। স্থানীয় প্রশাসনের তৈরি রাখাইনের রোহিঙ্গা পরিসংখ্যানে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব রাখা হয়েছে।
জিএডির তথ্য পর্যালোচনা করে ইউএনওসিএইচএ বলছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে গত তিন দশকে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে।
রাখাইনে মাত্র ৭৯ হাজার রোহিঙ্গা : জিএডি বলছে, সর্বশেষ সংকট শুরুর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গা ছিল ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮ জন। মংডু জেলার জিএডির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, এ পরিসংখ্যান ২০১৬ সালে সংগ্রহ করা হয়েছিল। জিএডি ও ইউএনওসিএইচএর রোহিঙ্গা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিম মিয়ানমারের তিনটি শহরে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৭৯ হাজার ৩৮ জন রোহিঙ্গা। তবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা যে ৯০ ভাগ রোহিঙ্গার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে; তার মধ্যে নিহত, নিখোঁজ বা গ্রেফতারকৃতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া দেশটির সেনা অভিযানে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত, নিহত রোহিঙ্গা, আহত হিন্দু বা রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি পরিসংখ্যানে।
জিএডি বলছে, ‘মডু ও বুথিডংয়ের মোট জনগোষ্ঠীর যথাক্রমে ৯৩ ও ৮৪ শতাংশ রোহিঙ্গা। রাথেডং শহরে মাত্র ৬ শতাংশ রোহিঙ্গার বাস। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় মংডু জেলার উপজাতি গোষ্ঠী ম্রো, থেট, হিন্দুসহ দেইঙ্গিত আরাকানিদের প্রায় ৩০ হাজার সদস্য গৃহহীন হয়েছে। বৌদ্ধসহ বাস্তুচ্যুত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা ইতিমধ্যে মংডু শহরে ফিরে গেছে। অন্যদিকে, বাস্তুচ্যুত হিন্দুরা এখনও সরকারি পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছে।
পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা : জিএডির প্রতিবেদনে বাঙালি বা রোহিঙ্গা শব্দ দুটির কোনোটিই ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবেও উল্লেখ করেনি রাখাইনের এ স্থানীয় প্রশাসন। ২০১৬ সালে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতি আহ্বান জানান। সু চির আহ্বানের পর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন রাখাইনের অ্যাডভাইসরি কমিশনের প্রতিবেদনেও রোহিঙ্গা শব্দটি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। জিএডির প্রতিবেদনে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি’ এবং ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পাড়ি জমানো অবৈধ অভিবাসী বলে চিহ্নিত করা হয়।
বিশ্বাস নেই কারও ওপর : গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেছেন মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লে. জেনারেল কিয়াও সোয়ে। বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিকভাবে তার হাতে ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা তুলে দিয়েছে; যাদেরকে ফেরত নেয়া হতে পারে। এ তালিকায় আরসার কোনো সদস্য আছে কিনা তা শনাক্ত করতে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। বিপরীতে রাথেডং এবং বুথিডংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও লড়াই চলছে। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শুরু থেকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২০৬ জন। এ ছাড়া সমুদ্রের পাশে অপেক্ষা করছে আরও ৮০৪ জন।
মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী : উখিয়া প্রতিনিধি জানান, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হলে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী। নতুন-পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফে প্রায় ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা ৫ হাজার একর বনভূমিতে ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পে ১ লাখ ৬৫ হাজার ঝুপড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশ পাসপোর্ট অ্যান্ড ইমিগ্রেশনে অধিদফতরের উপপরিচালক আবু নোমান মুহাম্মদ জাকের হোসেন জানান, শনিবার পর্যন্ত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন-পুরনো মিলিয়ে ১০ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪০ জন রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। নিবন্ধিত ওই সব রোহিঙ্গার আইডি কার্ড দেয়া হয়েছে, যাতে ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে রোহিঙ্গাদের ঝামেলা পোহাতে না হয়। শনিবার উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া, মধুরছড়াসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ঘুরে বয়োবৃদ্ধ ও বিভিন্ন শ্রেণীর রোহিঙ্গার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কথা হয়। তারা বারবার বলে আসছে, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হলে তারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী। বুচিদং কেয়াংপাড়া গ্রামের ছালামাতুল্লাহ (৪০) জানান, মিয়ানমারে ফিরে গেলে যদি জানাজা পড়ার পরিবেশ পাওয়া না যায় সে দেশে ফিরে যাওয়ার চাইতে এ দেশে না খেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। অন্তত পক্ষে মুসলমানের দেশে মরতে পেরেছি এটাই সান্ত্বনা হবে। তার পাশেই বসা আলি আহমদ (৪৫) জানান, মিয়ানমারে তাদের পুড়িয়ে দেয়া বাড়িঘরের ক্ষতিপূরণ, জায়গা-জমির মালিকানা ফেরত দিতে হবে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও সন্তানদের পড়ালেখার নিশ্চিয়তা দিলে কেউ তাদের এখানে ধরে রাখতে পারবে না।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন