ব্লগারকে হত্যার হুমকি
জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হলেন সেই বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার, এক্টিভিস্ট
বিজ্ঞান লেখক, মানবাধিকার কর্মী, নারী ও শিশু অধিকার, বাক-স্বাধীনতা নিয়ে স্বোচ্চার অলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগার এস এম সাইফুর রহমান পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আর্জি জানিয়েছেন তার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে। বিগত কয়েক বছর ধরে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গিরা তাকে একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তার কলম স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য। কুত্তার মতো পিটানো, যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে প্রকাশ্যে হত্যা করা, প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলানোসহ অসংখ্যবার তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গিরা। এতোদিন পুলিশ, প্রশাসন ও অভিজ্ঞজনদের পরামর্শ নিয়ে সাবধানে চলাফেরা করেছেন তিনি। কিন্তু দিনের পর দিন তার জীবন, বাইরের দুনিয়া সংকুচিত হয়ে পড়ায় এবার আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারন ডায়েরি (জিডি) করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রামপুরা মডেল থানায়।
সঙ্গত কারনে ও জনাব সাইফুরের অবস্থান প্রকাশ্য হওয়ার ভয়ে জিডির তারিখ ও নাম্বার উল্লেখ না করতে তিনি প্রতিবেদককে অনুরোধ করেছেন। তার ধারনা পুলিশ বাহিনীর কিছু মৌলবাদী চেতনার সদস্যের সঙ্গেও জঙ্গিদের সম্পর্ক থাকতে পারে। জঙ্গিরাও জিডি’র সূত্রে তার অবস্থান জেনে যেতে পারেন এবং তার চলাফেরার সংকুচিত স্বাধীনতা একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, এর আগেও ২০১৩ সাল থেকে একের পর এক ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্টকে প্রকাশ্য রাস্তায়, অফিসে গিয়ে, বাড়িতে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। তারাও পুলিশকে জানিয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
জনাব এস এম সাইফুর রহমান জানান, মানুষের অধিকারের পক্ষে, নারীদের পোশাকের স্বাধীনতার কারনে, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখালিখির কারনে একপ্রকার পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার, ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানমুখী মানবিক শিক্ষা ব্যবস্থা এসব নিয়ে লেখা ও মত প্রকাশ করা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি পেশায় একজন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিদ। ডি ফাইভ ক্রিয়েশান নামে নিজের একটি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান আছে যা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়দের একটি। অবসর সময়ে তিনি তার অনলাইন ব্লগে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখালিখি করেন। ধর্মীয় মৌলবাদ, সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি দুই দশক ধরে স্বোচ্চার। নিজেকে মানববাদী বা হিউম্যানিস্ট দাবী করা এই ব্লগার অধুনিক প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, নারী অধিকার, শিশু অধিকার, বাক-স্বাধীনতার পক্ষেও নিয়মিত লেখালিখি করেন। ভয়ংকর এক দুঃসময় অতিক্রম করছেন তিনি, অন্য মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে তার নিজের অধকারই আজ ভুলন্ঠিত। নিজের বাড়ি ছেড়ে বন্ধুদের বাড়ি, এখানে সেখানে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। বাড়িতে থাকলেও বাজার করার জন্য, অফিসের কাজে, দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাইরে তেমন বের হন না। পরিবারের সবাই তাকে নিয়ে শংকিত।
জিডি করতে গিয়ে জনাব সাইফুর দেখা করেন রামপুরা মডেল থানার ওসি জনাব মো. রফিকুল ইসলাম এর সঙ্গে। জনাব রফিক বলেন অভিযোগটি গুরতর, এর আগেও তারা হুমকি দিয়ে অনেক ব্লগার, অধিকারকর্মীকে হত্যা করেছে, এটাকা হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই, পুলিশ পাশে থাকবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার আন্তরিকভাবে বিষয়টি তদারক করবেন। যেহেতু এর সঙ্গে সাইবার ক্রাইম সম্পর্কিত সেহেতু পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগকে অবহিত করা হবে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে হুমকিদাতাদের সনাক্ত করার জন্য। যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার এস আই তাজুল ইসলাম প্রতিবেদককে জানান তিনি চেষ্টা করছেন হুমকিদাতাদের সনাক্ত করার জন্য। তবে যেহেতু সবাই ছদ্মনাম ব্যবহার করে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রোফাইলগুলো লক করা থাকে সেহেতু সনাক্ত করা খুব কঠিন। সাইবার ক্রাইম বিভাবের সহযোগীতা নিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
প্রধান হুমকিদাতা মোহাম্মদ ইসমাইল তার প্রোফাইল ইমেজে ব্যবহার করছেন মাওলানা জনাব মামুনুল হক সাহেবের ছবি। উল্লেখ্য যে, জনাব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উসকানি, জঙ্গি কর্মকান্ডে ইন্ধন যোগানোর বক্তব্য প্রচারের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তিনি এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
ভিন্নমতাদর্শের লেখক, কবিদের হুমকি, হত্যার ইতিহাস পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের হলেও ২০১৩ সালে জঙ্গিরা প্রকাশ্যে একসঙ্গে বাংলাদেশের ৮৪ জন ব্লগার, এক্টিভিস্টের তালিকা করে নাস্তিক উপাধি দিয়ে তাদের হত্যার ঘোষনা দেয়। অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, নাজিমুদ্দিন সামাদ, নীলয় নীল, রাজীব হায়দার, অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকী, শাহজাহান বাচ্চু, ফয়সাল আরেফিন দীপনসহ অনেকে রাস্তায় ও বাড়িতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে মাথায় ও ঘাড়ে গুরতর জখম হন তার স্ত্রী ও লেখিকা বন্যা আহমেদ। তারা দুজনই ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। জন্ম দেশে এসেছিলেন বাংলা বই মেলায় অংশ নিতে। মেলা থেকে বের হওয়া মাত্রই শত শত মানুষ, পুলিশ, সিসি ক্যামেরার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে পিছন থেকে চাপাতি দিয়ে ঘাড়ে কোপ দেয়া হয়। অভজিৎ রায় ঘটনাস্থলেই মারা যান, দীর্ঘ দিনের চিকিৎসায় বন্যা আহমেদ জীবন ফিরে পান। এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মম আক্রমনের শিকার হন অধ্যাপক ও নাস্তিক লেখক ডক্টর হুমায়ুন আজাদ, যে হামলার জেরে তিনি পরবর্তীতে মারা যান। প্রায় সব ক্ষেত্রেই জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার-আল-ইসলাম ও নব্য জেএমবি এসব হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে। এরা আল কায়েদা ও আই এস মতাদর্শে চালিত দেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠী। এদের ভয়ে জীবন বাঁচাতে অনেক ব্লগার, এক্টিভিস্ট জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে অন্যদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বিদেশে আশ্রয় নেয়া ব্লগার এক্টিভিস্টদের মধ্যে আসিফ মহীউদ্দিন, ইব্রাহীম খলিল সবাক, মাহমুদুল হাসান মুন্সি, সুসুপ্ত পাঠক, অমি রহমান পিয়াল, মাহবুব আলম কিন্তু, আসাদ নূর, সানিউর রহমান উল্লেখযোগ্য।
এতো হুমকি, জখম ও হত্যার পরও হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাইফুর রহমানের মতো অন্য ব্লগার, মুক্তমত ও বাক-স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা এক্টিভিস্টরা। অন্যদিকে তালিকা করে হত্যার হুমকি এবং ধারাবাহিকভাবে একাধিক জনকে হত্যা করা হলেও নিরাপত্তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় উদ্বিগ্ন ব্লগারা। এ কারণেই অনেকেই প্রাণনাশের আশঙ্কায় আত্মগোপনে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ-কেউ মনে ব্লগাররা সেক্যুলার মতাদর্শে বিশ্বাস করে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এ পর্যন্ত ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটকরা বলেছেন ইসলামবিদ্বেষী লেখার কারণে ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে ব্লগার বলতেই নাস্তিক, ইসলামবিরোধী পরিচয় দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে, যারা ব্লগে লেখেন, তারা সবাই নাস্তিক। এতে সমাজের সকল ধর্মপ্রাণ মানুষের মনেও ব্লগারদের উপরে একটা বিদ্বেষমূলক মনোভাব তৈরি হচ্ছে । অনেক ইসলামী বক্তা, জঙ্গি ও মৌলবাদীরা ব্লগারদের নাস্তিক হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং বাংলাদেশের মুসলিম প্রধান সমাজে নাস্তিকদের নির্যাতন ও হত্যাকে সমর্থন করার মতো মানুষ একেবারে কম নয়। বাংলাদেশের সমাজে ইসলামী বক্তা ও তাদের বক্তব্যের প্রভাব অনেক বেশী।
সচেতন মহল বলছে সরকার, প্রশাসন অন্ধকারের শক্তিকে দমন না করতে পারলে এরা দিনে দিনে আরো বেশী বেপরোয়া হয়ে যাবে। সুচিন্তার মানুষ, অধিকারকর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্ন ধর্মের মানুষ, সেক্যুলার নাস্তিক, মুক্তমনাদের নিরাপত্তা দেয়া ও তাদের বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনে সরকার বার বার ব্যর্থ হলে মুক্তমনাদের দেশ ছড়ে পালানো ছাড়া কোন গতি থাকবে না।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন