জীবন দিয়েও ভালোবাসার পরীক্ষা শেষ হয়নি তাদের!

ভালোবেসে এরপর ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেছিল নিপা। ভালোই কাটছিল লাইজু ও নিপা রানী ওরফে হোসনে আরার সংসার। কিন্তু বাধঁসাধে নিপার পরিবার। এতেই লন্ড ভন্ড জয়ে যায় তাদের জীবন ও স্বপ্ন। ফলে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয় ভালোবাসা সত্য। কিন্তু তাতেও কী দমেছে তাদের পরিবার? না।

ঘটনাটি নিলফামারি জেলার ডোমরা উপজেলার। পরিবার সূত্র জানা যায়, মরদেহ কে পাবে, আইনি এমন দ্বন্দ্বে সাড়ে তিন বছর ধরে হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে নিপা রানীর লাশ। ভালোবেসে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করার কারণে মরদেহ নিয়ে এমন আইনি লড়ায়ে জড়িয়ে পড়েন ছেলে ও মেয়ের পরিবার। মামলাটি বিচারিক আদালত ঘুরে দীর্ঘদিন ধরে হাইকোর্টে বিচারাধীন। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে মরদেহ হস্তান্তর করতে পারেনি রংপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সিনিয়র আইনজীবীরা বিষয়টিতে আইনের অমানবিক দিক উল্লেখ করে দ্রুত উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

মামলা সূত্রে জানা যায়, নিপা রানী ডোমার উপজেলার বামুনিয়া ইউনিয়নের খামার বমুনিয়া গ্রামের অক্ষয় কুমার রায় মাষ্টার মেয়ে। একই উপজেলার বোড়াগাড়ি ইউনিয়ন পূর্ব বোড়াগাড়ী গ্রামের জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমাউন ফরিদ লাইজু ইসলামের (২৩) সঙ্গে তার দীর্ঘ দিনের প্রেমের সর্ম্পক ছিল।

তারা ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর পালিয়ে যায়। এরপর লিপা রানী রায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মোছা. হোসনে আরা ইসলাম নাম ধারন করে এবং নীলফামারী নোটারি পাবলিক ক্লাবের মাধ্যমে এভিডেভিটে দুই লাখ ১ হাজার ৫০১ টাকা দেনমোহরে হুমাউন ফরিদ লাইজু ইসলাম কে বিয়ে করে। এরপর তারা স্বামী স্ত্রী হিসাবে বসবাস করে আসছিল।

এ অবস্থায় মেয়েটির পিতা অক্ষয় কুমার রায় ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর বাদী হয়ে নীলফামারী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে একটি অপহরন মামলা দায়ের করে। মামলার পর মেয়ে ও ছেলে স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে সকল কাগজপত্র সহ আদালতে হাজির হয়ে জবানবন্দি প্রদান করে। ফলে আদালত সার্বিক বিবেচনায় অপহরন মামলাটি খারিজ করে দেয়। এরপর মেয়ের বাবা মামলার খারিজ আপিলে তার মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়স্কো ও মস্তিস্কো বিকৃতি (পাগল) দাবি করে আদালতে কাগজ পত্র দাখিল করে।

আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে মেয়েটিকে শারিরিক পরীক্ষার জন্য রাজশাহী সেফ হোমে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। এ অবস্থায় মেয়েটি সেখানে অবস্থান করছিল। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারী মেয়েটির স্বামী হুমায়ূন ফরিদ ওরফে লাইজু ইসলাম বিষপান করে আত্নহত্যা করে। এরপর মেয়েটির স্বামী হুমায়ূন ফরিদ লাইজু ইসলাম আত্নহত্যা করার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করে মেয়ের বাবা মেয়েকে তার জিম্মায় নিতে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করলে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারী মেয়েকে নিয়ে বাবা তার বাড়িতে নিয়ে নিজ জিম্মায় রাখেন। তবে মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়স্কো ও মস্তিস্কো বিকৃতি (পাগল) দাবি করে আদালতে দায়ের করা মেয়ের বাবার মামলটি চলমান ছিল।

এ অবস্থায় মেয়েটি ২০১৪ সালের ১০ মার্চ দুপুরে বাবার বাড়ীর নিজ শোয়ার ঘরে সবার অগোচরে কীটনাশক পান করে। তাকে ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎষাধীন অবস্থায় ওই দিন রাত ৮টার দিকে মারা যায়। ডোমার থানা পুলিশ হাসপাতাল হতে মেয়েটির মরদেহ রাতেই উদ্ধার করে।

এরপরের দিন ওই বছরই ১১মার্চ নীলফামারী জেলার মর্গে মেয়েটির মরদেহ ময়না তদন্ত করা হয়। ওই দিন পুত্রবধূ দাবী করে মেয়েটির শ্বশুড় জহুরুল ইসলাম-ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক দাফনে ও মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার রায় হিন্দু শাস্ত্রে সৎকারের জন্য তাৎনিকভাব নীলফামারী জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আবেদন করে। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) এর আদালতে উভয়পক্ষের শুনানী চলে দিনসন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।

মেয়ের বাবার পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. অসিত কুমার ধর জানান ওই শুনানীতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বিষয়টি ডোমার থানা পুলিশকে একটি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদেশ প্রদান করেছিল।

এ ব্যাপারে ডোমার থানার তৎকালিক ওসি (তদন্ত) আইউব আলী মেয়ে ও ছেলে পক্ষকে ডেকে বিষয়টি নিজেদের মধ্যে সমাধানে অনুরোধ করে। কিন্তু উভয় পক্ষ নিজেদের অবস্থানে অটুট থাকায় ডোমার থানা পুলিশ আদালতে ১২ মার্চ একটি প্রতিবেদন দাখিল করলে আদালত মেয়েটির মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংরক্ষণের আদেশ প্রদান করে। ফলে সেই হতে মেয়েটির মরদেহ সেখানে রাখা হয়।

বুধবার (১৫ নভেম্বর) নীলফামারী জেলা জজ আদালতের পিপি অক্ষয় কুমার রায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা হলে তিনি জানান, আমরা উভয়পক্ষকে ডেকে এটি সমাধাণে মেয়েটির মরদেহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করার প্রস্তাব করি।

কিন্তু উভয়পক্ষ এতে রাজি হয়ননি। ফলে মেয়েটির মরদেহের দাবির মামলায় মেয়েটির শ্বশুড়ের পক্ষে গেলে মেয়ের বাবা তা সাব-জজ আদালতে আপিল করেন। সেখানে ছেলের বাবা জহুরুল ইসলাম হেরে যান। এরপর মেয়েটির শ্বশুড় জহুরুল ইসলাম ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে বিচারধীন রয়েছে। ফলে মামলার জটিলতার কারণে মেয়েটির লাশ আজও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিম ঘরে রক্ষিত আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন মামলার রায়ে যিনি মরদেহের ভাগিদার হবেন তাকে হিমঘরের ভাড়া পরিশোধ করে মরদেহ গ্রহণ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের রায়ে হিসঘরের ভাড়া বিবেচনাও হতে পারে।

এ ব্যাপারে মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার রায় মাষ্টার জানান, তিনি মেয়ের মরদেহ সৎ কারের জন্য আজও অপেক্ষা করছেন। আর কতদিন আমার মেয়ের মরদেহ হিমঘরে থাকবে? এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।

অপর দিকে জহুরুল ইসলাম বলেন, পুত্রবধূর মরদেহ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক দাফন সম্পন্ন করতে আদালতে রিট করেছি। কারন সে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে আমার ছেলেকে বিয়ে করেছিল। তাকে আমি পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নিয়েছি এবং ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক দাফন সম্পন্ন করতে চাই।