জুলাই সনদ: ফিরছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আইনসভা ২ কক্ষের, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান নয়

ফিরছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবে যেভাবে2
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়ায় একটি সংসদের মেয়াদ শেষ হলে বা কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
কোন প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হবে তারও পরিপূর্ণ রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে।
শনিবার (১৬ আগস্ট) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই সনদের খসড়া থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: বিদ্যমান সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে যেসব বিধান সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
(১) মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্যকোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
(২) সংবিধানের ৫৮ (খ) সংশোধনপূর্বক সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ১৫ দিন পূর্বে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী পনেরো (১৫) দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
(৩) মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ দিন পূর্বে জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায়— ১. প্রধানমন্ত্রী, ২. বিরোধীদলীয় নেতা, ৩. স্পিকার, ৪. ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং ৫. সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি— (যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্য থেকে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে) মোট পাঁচ (৫) সদস্য সমন্বয়ে একটি ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। কমিটির যে কোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার।
(৪) কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবেন এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি দল একজন এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন।
(৫) রাজনৈতিক দলসমূহ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে তাদের প্রস্তাবিত নাম দাখিল করবেন।
(৬) পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটির সদস্যরা সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দলসমূহ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নামসমূহ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদের অধীনে উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য হতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
(৭) বাছাই কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ১২০ ঘণ্টার মধ্যে এ পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্ত অনুসরণপূর্বক সংসদের সরকারি দল/জোট ৫ (পাঁচ) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট পাঁচজন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে।
এছাড়া সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল দুইজন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে।
যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্যে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত নামসমূহ স্পিকার জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবেন।
(৮) উপর্যুক্ত চ-এ বর্ণিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি দল/জোটের প্রস্তাবিত পাঁচজন ব্যক্তির তালিকা থেকে প্রধান বিরোধী দল/জোট যে কোনো একজনকে বেছে নেবে।
অনুরূপভাবে প্রধান বিরোধী দল প্রস্তাবিত পাঁচ ব্যক্তির নামের তালিকা থেকে সরকারি দল যে কোনো একজনকে বেছে নেবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের প্রস্তাবিত মোট দুইজনের নামের তালিকা থেকে সরকারি দল/জোট যে কোনো একজনকে বেছে নেবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট যে কোনো একজনকে বেছে নেবে।
এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত নামসমূহের মধ্য থেকে যে কোনো একজনের ব্যাপারে যদি প্রস্তাবকারী দলগুলোর মধ্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত হবেন।
অথবা কোনো একজনের ব্যাপারে কমিটির পাঁচজন সদস্যের মধ্যে যদি চারজন সদস্য একমত হন তাহলে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত হবেন।
(৯) যদি এই পদ্ধতিতে কোনো একজনের বিষয়ে প্রস্তাবকারী পক্ষসমূহ একমত হতে না পারে তাহলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগের দুইজন প্রতিনিধি বাছাই কমিটিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হবেন এবং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কারও নাম প্রস্তাব করতে পারবেন না।
এই দুইজন প্রতিনিধির মধ্যে একজন আপিল বিভাগের বিচারপতি হবেন এবং একজন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হবেন। বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধিকে মনোনীত করার জন্য—১. সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, ২. কর্মরত প্রধান বিচারপতি এবং ৩. আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হবে।
(১০) এই পর্যায়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট বাছাই কমিটির সদস্যরা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে গোপন ব্যালটে ‘র্যাংকড চয়েজ’ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে যে কোনো একজনকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন।
(১১) উপর্যুক্ত যে কোনো পদ্ধতিতে মনোনীত ব্যক্তিকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি পরবর্তী ৯০ দিনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় তিনি শপথ গ্রহণ করবেন না।
(১২) উপর্যুক্ত পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বেছে নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসরণ করতে হবে; তবে শর্ত থাকে যে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া যাবে না।
(১৩) কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি কোনো সময় ব্যতিরেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পূর্ববর্তী র্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানালে অথবা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে র্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে পরবর্তী স্থানে থাকা ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হবেন।
এই পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা পদে পরিবর্তন হলেও পূর্বতন উপদেষ্টা পরিষদ বহাল থাকবে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের কোনো পদ শূন্য হলে নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা সেই শূন্যপদ পূরণের অধিকার রাখবেন।
(১৪) নিয়োগলাভের পর প্রধান উপদেষ্টা উপর্যুক্ত বাছাই কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য হতে অনধিক ১৫ (পনেরো) জন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের জন্য বেছে নেবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ প্রদান করবেন।
(১৫) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত সংসদের একই ধরনের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে এবং কমিটি পরবর্তী ১৪ দিন তথা ৩৩৬ ঘণ্টার মধ্যে উক্তরূপ অভিন্ন পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবে এবং তিনি অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন।
(১৬) সংবিধানের ৫৮(৭)(ঘ) সংশোধন করে ‘বাহাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন’ এর পরিবর্তে ‘পঁচাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন’ শব্দসমূহ প্রতিস্থাপিত হবে।
(১৭) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন এবং উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
(১৮) সংবিধানে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও এখতিয়ার ও অবসানের সময়সীমা নির্ধারিত হবে।
(১৯) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক ৯০ দিন। তবে দৈব-দুর্বিপাকজনিত কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরও সর্বোচ্চ ৩০ দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
(২০) নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তার পদের কার্যভার গ্রহণ করবেন সেই তারিখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে।
*ত্রয়োদশ সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ৫৮(গ) (২) ব্যবস্থা বহাল থাকবে।
এই প্রস্তাবগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, বিএনপি (গঠন প্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে), বাংলাদেশ লেবার পার্টি (৯,১০ ও ১৩), এনডিএম (৮, ৯,১২), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট (৯,১০,১৩), ১২ দলীয় জোট (৯,১০,১৩), জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (৭,৮), বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি (৭ ও ১০)।
আইনসভা হবে ২ কক্ষের, নিম্নকক্ষের নাম জাতীয় সংসদ-উচ্চকক্ষ সিনেট
জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রস্তাবে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠনের কথা বলা হয়েছে। নিম্নকক্ষের নাম জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষের নাম সিনেট প্রস্তাব করা হয়েছে।
শনিবার (১৬ আগস্ট) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই সনদের খসড়া থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এতে আইনসভা গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে, বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকবে, যার নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষ (সিনেট) ১০০ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে।
নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন।
উচ্চকক্ষের মেয়াদ হবে শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে ৫ বছর। তবে কোনো কারণে নিম্নকক্ষ ভেঙে গেলে উচ্চকক্ষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সময় একই সঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। তালিকায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী থাকতে হবে।
উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের প্রস্তাবিত আইন প্রণয়নের পর্যালোচনা করবে। উচ্চকক্ষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না; তবে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য নিম্নকক্ষ বরাবর প্রস্তাব করতে পারবে।
নিম্নকক্ষে পাসকৃত অর্থবিল এবং আস্থা ভোট ব্যতীত সকল বিল উচ্চকক্ষে উপস্থাপিত হতে হবে। উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকাতে পারবে না। উচ্চকক্ষ কোনো বিল সর্বোচ্চ ২ মাসের বেশি আটকে রাখলে, তা উচ্চকক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে।
যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে সেক্ষেত্রে উভয়কক্ষ কর্তৃক পাসকৃত বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ সংশোধনের সুপারিশসহ বিল পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে পাঠাবে নিম্নকক্ষ উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত সংশোধনগুলো সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।
উচ্চকক্ষের কাছ থেকে ফেরত পাঠানো বিল যদি নিম্নকক্ষের অধিবেশনে আবারও পাস হয়, তবে উচ্চকক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত যে কোনো বিল উচ্চকক্ষের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করতে হবে।
উল্লিখিত বিধান অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে সংবিধানের পঞ্চম ভাগে প্রয়োজনীয় সংযোজন ও সংশোধন করা হবে। তাছাড়া সংবিধানের অন্যান্য ভাগেও কিছু কিছু সংশোধন করা হবে। এছাড়া নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের গঠন প্রক্রিয়ায় এবং বর্ণিতভাবে উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কিত বিধান
অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে সংবিধানের পঞ্চম ভাগে প্রয়োজনীয় সংযোজন ও সংশোধন করা হবে।
উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে, উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নিম্নকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতার অনুরূপ হবে।
প্রধানমন্ত্রী হলে থাকা যাবে না দলীয় প্রধানের পদে
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে কোনো ব্যক্তি দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না, সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট–– এসব সুপারিশ উঠে এসেছে ‘জুলাই সনদের’ খসড়ায়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি করা ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে খসড়ায়।
জুলাই সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও শক্তিসমূহ পারস্পরিক ও সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে এসব বিষয়ে একমত হওয়া গেছে।
তবে সব দল সব বিষয়ে একমত হয়নি, কোনো কোনো দল কোনো কোনো সুপারিশের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে।
সনদের পটভূমিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি।
‘রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের’ মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকরী ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকার ‘জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা কায়েম করে’ বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ‘জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়’ এবং এরপর ‘জনগণের মননে রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের এক প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে’–– সনদে বলা হয়েছে।
যেসব বিষয়ে ঐকমত্য: রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধান
রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে ‘বাংলা’ এবং বাংলাদেশে নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত অন্যান্য সব ভাষাকে দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
বাংলাদেশের নাগরিকরা ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবে।
সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে; এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে।
সংবিধান বিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা বিষয়ক বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ বিলুপ্ত করা হবে।
বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪১ক সংশোধনের সময় ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে।
জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিরোধী দলীয় নেতা অথবা তার অনুপস্থিতিতে বিরোধী দলীয় উপনেতার উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
জরুরি অবস্থাকালীন নাগরিকের দুটি অধিকার–– (ক) জীবনের অধিকার ও (খ) বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে বিদ্যমান সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ খর্ব করা যাবে না।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার
সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ থাকবে।
সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদার প্রশ্নে সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে, ‘বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হইবে।’
মৌলিক অধিকারের তালিকা সংশোধন ও সেগুলো বাড়ানো হবে।
মূলনীতির ক্ষেত্রে পাঁচটি দল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি জানিয়েছে বলে ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির জায়গায় বলা হয়েছে, সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী আইনসভার উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন।
রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সময় কোনো ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াতে সংবিধানে সংশোধনীর প্রস্তাব করা হবে। কারো পরামর্শ বা সুপারিশ ছাড়াই নিজ এখতিয়ারবলে রাষ্ট্রপতি নিম্নলিখিত পদে নিয়োগ দিতে পারবেন––
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ।
রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে––‘রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাইবে। আইনসভার নিম্নকক্ষে অভিশংসন প্রস্তাবটি দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে পাস করিবার পর তা উচ্চকক্ষে প্রেরণ এবং উচ্চকক্ষে শুনানির মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হইবে।’
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার জায়গায় বলা হয়েছে, কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বনস্থা ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে-কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড, নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণক্রমে উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে। সংশ্লিষ্ট আইনে এরূপ বিধান রাখা হবে যে, এরূপ কোনো আবেদন বিবেচনার পূর্বে মামলার বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারের সম্মতি গ্রহণ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ
একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যতবারই হোক সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন, এজন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে–– প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একইসঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন না, এরূপ বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হবে।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন