জেলগেটে বাবার সঙ্গে ৪ মিনিট যে কথা হলো মিন্নির
বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার মামলার প্রধান সাক্ষী ও তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সঙ্গে শনিবার জেলগেটে দেখা করেছেন তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। ব্যাপক নজরদারির মাঝে মা-মেয়ের মধ্যে মাত্র ৪ মিনিটের কথা হয়েছে।
এ সময় কিশোরের সঙ্গে ছিলেন মিন্নির মা জিনাত জাহান মনি, চাচা মহিউদ্দিন দুলাল ও আবু সালেহ। মেয়ের সঙ্গে মাত্র ৪ মিনিট কথা বলতে পেরে ক্ষুব্ধ তার বাবা। তিনি বলেন, ‘মিন্নি কয়, আব্বু, আমি আর বাঁচব না।’
সকাল সাড়ে ১০টায় জেলগেটে মিন্নির সঙ্গে দেখা করেন বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কিশোর যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার মেয়ে খুবই অসুস্থ। মেয়েকে দেখে চিনতে পারিনি। আমার মেয়ের দিক চাওন যায় না। মেয়ের সঙ্গে একটু কথা কমু তাও পারি না। গোয়েন্দারা গায়ের সঙ্গে দাঁড়াইয়া থাকে। মিনিট চারেক কথা কইয়া রাগ করিয়া চইলা আসি। মিন্নি কয়, ‘আব্বু আমি আর বাঁচব না।’ আমার সন্দেহ, আমার মাইয়াডারে জীবিত বাইর করতে পারুম কিনা জানি না।’
কিশোর বলেন, ‘মিন্নি একেবারে কাহিল হইয়া গেছে। ও বলেছে, তার মাথায় ও বুকে ব্যথা। সারা শরীরে ব্যথা। মিন্নি খুবই দুর্বল।’
মিন্নির মা কথা বলেছেন কিনা জানতে চাইলে কিশোর বলেন, কীভাবে কথা বলবে। গোয়েন্দা দাঁড়াইয়া থাকে। ভাই আমিও অসুস্থ। কেমনে সুস্থ থাকব। আমার জীবনে এমন একটা ধস নামবে। আমার পরিবারটাই তো শেষ। আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেষ। আমি কেমনে বাঁচমু। আমার মেয়েটাকে জেলখানায় কোনো খাবার দিতে পারি না। জেলখানায় টাকা দিই। সেই টাকা দিয়ে জেলখানার ভেতর ক্যান্টিন থেকে কিনে খায়।
মিন্নির কী হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে কিশোর বলেন, ‘আপনারা বোঝেন না? রিমান্ডে নিয়ে কী করে। কেন আমার মেয়ের শরীরে ব্যথা হয়েছে। খালি খালি কি ব্যথা হতে পারে। তিনি বলেন, মিন্নি কিছু আমাকে বলতে চায়। কিন্তু গোয়েন্দা দাঁড়াইয়া থাকে, তাদের জন্য কিছু বলতে পারে না।’ প্রসঙ্গত বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় ২৬ জুন সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। বিকাল ৪টায় বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
এ হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
রিফাত হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে গিয়ে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর থেকে মামলা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
১৬ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বরগুনার মাইঠা এলাকার বাবার বাসা থেকে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বক্তব্য রেকর্ড করতে বরগুনা পুলিশলাইনসে নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯টায় মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
পর দিন মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। আদালত মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী।
পর দিন বৃহস্পতিবার বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
গত শুক্রবার বিকালে মিন্নি একই আদালতে তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের দাবি, মিন্নির কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তিনি এ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে (মিন্নি) আসামি করা ও রিমান্ডে নেয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে দায়ী করে আসছেন। শুক্রবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছুই শম্ভু বাবুর খেলা। তার ছেলে সুনাম দেবনাথকে রক্ষা করার জন্য আমার মেয়েকে বলি দেয়া হচ্ছে।’ শম্ভুর ছেলে সুনামের বিরুদ্ধে কিশোরের অভিযোগ, তার জন্যই এতদিন মিন্নির পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি আইনজীবীরা। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু সমালোচনার পর বরগুনা ও ঢাকার আইনজীবীদের একটি অংশ মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন