ঝুঁকিতে বাংলাদেশের একমাত্র আফ্রিকান টিকওক গাছ
বাংলাদেশের একমাত্র ক্লোরোফর্ম বৃক্ষ আফ্রিকান টিকওক নামে পরিচিত যা একসময় স্থানীয়দের কাছে অজ্ঞান গাছ হিসেবে পরিচিত ছিল। এক সময় লোকমুখে প্রচার ছিল যে এই গাছের পাশ দিয়ে পথচারি হেঁটে গেলে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে এই গাছে কার্বলিক অ্যাসিড ও ক্লোরোফর্মের উপস্থিতির কারণে একটু ঘুম ঘুম ভাব তৈরি হতে পারে। আবার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নাক ও গলাতে জ্বালা এবং হাপানির সম্ভাবনা থাকে।
মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেশের একমাত্র ক্লোরোফর্ম বৃক্ষ আফ্রিকান টিকওক গাছটি দাঁড়িয়ে আছে তবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় গাছটি হুমকির মুখে রয়েছে। এদিকে গাছটির একপাশের মাটি সরে যাওয়ায় পাশ দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ী ছড়ার দিকে হেলে পড়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝড় তুফানে বা জোরে বাতাস হলে গাছটি উপড়ে পড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিপন্ন প্রজাতির এই গাছটিকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য বন বিভাগ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগে উঠেছে।
বনবিভাগের দেয়া তথ্যমতে, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আফ্রিকান টিকওক জাতীয় দুইটি দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। ২০০৬ সালের ৭ জুলাই একটি গাছ ঝড়ে উপড়ে পড়ে। সেটির গুড়ির একাংশ এখনও উদ্যানে স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে। উদ্যানের মূল ফটক থেকে ভেতরে প্রবেশ পথের দুপাশে সারি সারি বিশাল আকৃতির নানা প্রজাতির গাছের একেবারে শেষ দিকে বন বিট কার্যালয় থেকে প্রায় ১০০ ফুট দূরে রাস্তার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিরল প্রজাতির টিকওক বৃক্ষটি।
জানা যায়, আফ্রিকান টিকওক প্রজাতির ক্লোফোরা এক্সেলসা (সাধারণত আফ্রিকান টাক, মভিলে বা ইরোকো নামে পরিচিত) ক্রান্তীয় আফ্রিকার একটি গাছ। এটি ১৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এ জাতীয় গাছ আফ্রিকা মহাদেশের অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গিনি, ইথিওপিয়া, গ্যাবন, ঘানা, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া, মালাউই, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডাসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এর প্রাকৃতিক বাসস্থান রেইন ফরেস্ট চিরহরিৎ বনে। বর্তমানে এই প্রজাতিটি আদি জন্মভূমি আফ্রিকাতেই ঝুঁকির মুখে রয়েছে। স্থানীয়ভাবে আফ্রিকান টিকওক ছাড়াও আবেং, আলা, বঙ্গ, বাঙ্গি, বাঙ্গু, ডেইডি, ইরোকো, কাম্বালা, মুকুকো, মুরিতুলুল্ডা, মুউলে, মউউল, নোংন্ড, ওডুম, টুলে, উলোকো, আফ্রিকান ওক, লোকো, এমএসুল, মালালা, অজিজ, রোক, সিঙ্গা নামে ডাকা হয়।
জানা যায়, আফ্রিকায় ঐতিহ্যগতভাবে এটিকে পবিত্র গাছ বলে মনে করা হয়। এটির নীচে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় এবং এই গাছের নিচে উপহার তুলে দেয়ার প্রথাও আছে। এই গাছের কাঠ বাদ্যযন্ত্র ড্রামস এবং কফিন বানাতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আসবাবপত্র, ঘরের মেঝে এবং নৌকা তৈরি জন্য ব্যবহৃত হয়। এ জাতীয় গাছ পঞ্চাশ বছর পরে কাটার জন্য প্রস্তুত হয়। অন্যদিকে ভেষজ ঔষধি গাছ হিসেবে আফ্রিকায় এই গাছের পাতা-বাকলের বহু ব্যবহার ছিল। বিশেষ করে কাশি, হার্টের সমস্যা এবং দুর্বলতার জন্য ব্যবহার করা হয়। ল্যাটেক্স অথাৎ এ গাছের কষ এক ধরণের অ্যান্টি-টিউমার অ্যাজেন্ট হিসেবে কাজ করে।
জানা যায়, ১৯৩০ সালে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে কয়েকটি চারা রোপন করেন। এর মধ্যে দুটি গাছ টিকে ছিল। বর্তমানে টিকে থাকা প্রায় ৯০ বছর বয়স্ক বৃক্ষটির পরিধি প্রায় ১৫ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন জানান, গ্রাফটিং করে এই গাছের বংশ বৃদ্ধি করা জরুরি। যেহেতু দেশে আর এই প্রজাতির গাছ নেই। এই গাছ রক্ষা করতে না পারলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি গাছ অচেনা থেকে যাবে। শত বছরের কাছাকাছি একটি গাছ সেখানের পরিবেশের সাথে মিশে গেছে তাই একে রক্ষা করা পরিবেশের জন্যও জরুরি।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আবু মোছা শামছুল মোহিত চৌধুরী জানান, এটি অবশ্যই একটি দুর্লভ গাছ। গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে গাছটির বংশবিস্তারের পাশাপাশি এটাকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন