ঝোপের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে অতীতের গোপন কলঙ্ক
শেলী মিত্র, কলকাতা : নাম যার ‘হেরিটেজ ওয়াক’। এমনই এক হেরিটেজ ওয়াকের আওতায় পড়ে কলকাতার মেটিয়াবুরুজ অঞ্চল। বাংলার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ, তার শেষ দিনগুলি এখানেই কাটিয়েছিলেন। কিন্তু, আজ নবাব নয়, মেটিয়াবুরুজের অন্য এক স্থান নিয়ে কথা বলা যাক।
কলকাতার মেটিয়াবুরুজের সিইএসসি পাওয়ার হাউস। ধুলো উড়িয়ে যখন গাড়ি গিয়ে থামল তার সামনে, তখনও কেউ ভাবিনি সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই ছুঁতে পারব ইতিহাসের এক কালো মুহূর্তকে।
কালোই বটে! কারণ তখন চুক্তি-শ্রমিক প্রথা চলছে রমরমিয়ে। ভারত থেকে সস্তার মজদুর চালান হতো সাগরপারের নানা দেশে। আর তা হতো এই পথ দিয়েই। প্রবাসে চুক্তি শ্রমিকদের জীবন ছিল ভয়াবহ। চুক্তি পর্ব শেষ হওয়ার আগে তারা দেশে ফিরতে পারত না। আর বিভুঁইয়ে অখাদ্য খেয়ে, রোগে ভুগে, অতিরিক্ত শ্রম করে তাদের একটা বড় অংশ সেখানেই মারা যেত।
দিন বদলায়। একদিন সেই প্রথা লুপ্ত হয়। প্রবাসে একদিন তুমুল সংগ্রাম করে টিকে থাকা চুক্তি-শ্রমিকের একাংশ অনেক লড়াইয়ের পরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু অতীতের কলঙ্ককে তারা ভোলেননি। দারিদ্র্যের কারণে তাদের পূর্বপুরুষদের কী পরিমাণ অবিচার সইতে হয়েছিল, ভোলেননি তা।
কলকাতায় তখন এই পাওয়ার হাউস ছিল না। তাই, সেই পথ বর্তমানে এমন রূপ নিয়েছে যে দিনের আলোতেও একা যেতে খানিক গা ছমছম করবে। এক চিলতে পথের দু’পাশের দেওয়ালে মাঞ্জার রঙের ছিটে।
কেমন একটা দমবন্ধ ভাব। কিন্তু, কিছু দূর হাঁটার পরে দেওয়াল শেষ হতেই ঠান্ডা হাওয়ার পরশ ছুঁয়ে যায় সকলকে। সামনে বিশাল খোলা অঞ্চল, তার পরেই হুগলি নদী। আর তার পরে ইতিহাস…
সুরিনাম ঘাট। হুগলি নদীর এক অজানা ঘাট, যা রয়েছে এ শহরেই। বাবুঘাট, প্রিন্সেপ ঘাটের মতো জৌলুস তার নেই। মেটিয়াবুরুজের বিচালি ঘাটের মতো এখান থেকে যাত্রী আনাগোনাও হয় না। তা সত্ত্বেও, এই ঘাট জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলের সব থেকে ছোট একটি দেশ, নাম সুরিনাম। অতলান্তিক মহাসাগরের পাড় ঘেঁষেই রয়েছে এই দেশ। কিন্তু, সুদূর আমেরিকার ওই ছোট্ট দেশটির নামে কলকাতা শহরে ঘাট, কিছুটা হলেও আশ্চর্যের ব্যাপার! আসা যাক সে কথায়।
একটা সময়ে ভারত থেকে সস্তার মজদুর নিয়ে যাওয়া হতো দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, মরিশাস, গায়েনা ও ফিজিতে। আখের ক্ষেতে শ্রমিকের কাজ করত তারা। মূলত, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও বাংলা থেকেই এই শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হত সুরিনামে।
বিভিন্ন রাজ্য থেকে শ্রমিকরা এসে জুটত কলকাতায়। সেখান থেকে ফেরি করে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন জেটিতে। এবং সেখান থেকে তারা চালান হয়ে যেত বিদেশে। সেই সব দেশের নামানুসারেই জেটি বা ঘাটগুলির নামকরণ হয়।
সুরিনামের রাজধানী শহর, পারামারিবু। আরাওয়াক ও কারিব ‘ইন্ডিয়ান’রা এখানকার আদি বাসিন্দা ছিল বলে জানা যায়। কথিত, ১৪৯৮ সালে, আলোন্সো দে ওজেদা নামে এক স্পেনীয় অভিযাত্রী, সুরিনাম আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযানের সঙ্গী।
এরপরে, সতেরো শতকের গোড়া থেকে আমেরিকায় শুরু হয় ডাচ-দের বসবাস। এবং ১৬৬৭ সালে সুরিনাম হয়ে যায় ডাচ উপনিবেশ। এক সময়ে ব্রিটিশরা এ জায়গা দখল করলেও, বেশি দিন তা ধরে রাখতে পারেনি। সুরিনাম প্রায় ৩০০ বছর ধরে ডাচদের অধীনেই ছিল।
ভারত থেকে সুরিনামে শ্রমিকদের পাঠানোর এই শ্রমিক চালান এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায় এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ঘাটগুলিও তাদের মর্যাদা হারাতে থাকে। শোনা যায়, প্রতি পুরুষ শ্রমিকের জন্য ২৫ টাকা ও মহিলা কর্মীর জন্য ৩৫ টাকা পেত দালালরা।
বদলে শ্রমিকরা পেত একটা থালা, একটি লোটা, ধুতি ও পাঞ্জাবি (পুরুষদের ক্ষেত্রে) এবং শাড়ি (মহিলাদের জন্য)। জাহাজে প্রায় তিন মাস সময় লাগত সুরিনাম পৌঁছাতে। ১৮৭৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট ৬৫টি জাহাজে ৩৪,৩০০ ভারতীয় শ্রমিক পাড়ি দেয় সুরিনামের উদ্দেশ্যে।
ইতিহাসে এই ঘাটের নাম সুরিনাম হলেও, স্থানীয়দের কাছে তা ‘বালু ঘাট’ নামেই পরিচিত। মেটিয়াবুরুজের এই অঞ্চলের সঙ্গে সুরিনামের সম্পর্ক ১৫০ বছরেরও বেশি। এবং সেই সম্পর্ককে সম্মান জানাতেই দু’দেশের সরকার এক অভিনব কাজ করে।
পারামারিবুতে এক সাধারণ ভারতীয় যুগলের মূর্তি স্থাপন করে সুরিনাম সরকার। কারণ, ১৮৭৩ সালের ৫ জুন, ওই স্থানেই প্রথমবার পা রেখেছিলেন কোনও এক ভারতীয় শ্রমিক। এবং একই মূর্তি কলকাতার সুরিনাম ঘাটেও স্থাপন করা হয়। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এই মূর্তি উন্মোচন করেন ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর।
ইতিহাস জানতে কার না ভাল লাগে! তাই বর্তমানে সুরিনাম ঘাট মানুষদের বেশ আকর্ষণ করছে। এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রকের কল্যাণে এই স্থান দেখতে আসছেন বিদেশি পর্যটকরাও। কিন্তু কোনও রকম রোড সাইন না থাকায় বিভ্রান্তি হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক।
তাই জায়গাটির উন্নতি সাধনে পা বাড়িয়েছে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের কলকাতা দফতর, জানালেন ডায়রেক্টর কাজরী বিশ্বাস। তিনি জানিয়েছেন যে, সুরিনাম ঘাট আরও বেশি করে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার জন্য কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও কোনও রকম আলোচনা হয়নি। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট-এর সঙ্গে আপাতত কথা হয়েছে বিদেশমন্ত্রকের। অনেক বাধা পেরতে হবে সুরিনাম ঘাটকে বিশ্বমানের পর্যটক স্থান হিসেবে স্থাপন করতে। এবেলা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন