টানা বর্ষণে বাড়ছে পাহাড় ধসের শঙ্কা
বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষহীন ন্যাড়া এবং অপরিকল্পিতভাবে মাটিকাটা পাহাড়গুলো আশেপাশে বসাবসকারী লাখ লাখ মানুষের জন্য ’মৃত্যু ফাঁদ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঠচোরদের বেপরোয়া তৎপরতায় পাহাড়ি বন উজাড় হচ্ছে আর অব্যাহতভাবে পাহাড় কেটে মাটি চুরি চলতে থাকায় চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড় ধসের ট্রাজেডি ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
চলতি মৌসুমে আষাঢ় আসার সপ্তাহখানেক আগে থেকে প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। দিনগড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির গতি বাড়ছে। মুষলধারে টানা এই বর্ষণ পাহাড়ি জনপদের জন্য নিয়ে এসেছে বিপদসংকেত। ভারি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আবহাওয়ার অধিদপ্তরের পূর্বাভাসেও জানানো হয়েছে সেই আশঙ্কার কথা।
শনিবার দুপুরে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, , মৌসুমী বায়ু অক্ষের বর্ধিতাংশ পূর্ব-উত্তর প্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল ও মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় ও উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় আছে। ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত এবং পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম জানান, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ভারী বর্ষণের সংকেত রয়েছে আমাদের কাছে। ফলে চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের শঙ্কা রয়েছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬ জেলার ১১টি থানা এলাকায় এখন পাহাড় ধসের ঝুঁকির মুখে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর পার করছে তারা অনেকটা নিয়তি-নির্ভরতার মধ্যে। প্রতি বর্ষা মৌসুম এলেই প্রমাদ গোণে তারা, টানা বর্ষণের দিনগুলোতে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় পাহাড় ধসে জানমালের সর্বনাশের আশংকায়।
চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গত ১৪ বছরে পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় সাড়ে তিনশ’ মানুষ। এরমধ্যেে একটি বড় ট্রাজেডি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওই দিনে চট্টগ্রামের সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন।
পাহাড় ধসের আরো কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। স্মরণকালে ভয়াবহ ট্রজেডি ঘটে ২০১৭ সালে। ওই বছর ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। এছাড়াও ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে এভাবে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
এভাবেই প্রতি বর্ষায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আসে পাহাড়ি জনপদে,পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। বছরের পর বছর এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও দীর্ঘস্থায়ী কোন ব্যবস্থা নেয় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বরং বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টি শুরু হলে এসব বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু হয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪। এসব পাহাড়ে বসবাসকারীর মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজারের অধিক।
পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্নআয়ের। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টাকার বিনিময়ে নিম্নআয়ের মানুষের ঘর তৈরি করতে নির্বিচারে পাহাড় কাটছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থিতিয়ে যায়।
চট্টগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধ করা যাচ্ছে না। তাদের নির্লিপ্ততার কারণে ছিন্নমূল, বানেভাসা, নদীভাঙা, জলবায়ু তাড়িত, ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষগুলো নগরীতে এসে কম টাকায় থাকতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিতে পড়ছেন। যে কারণে প্রতিবছর বর্ষায় চট্টগ্রামের কোনও না কোনও এলাকায় পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এর পেছনে নগরবাসী সরকারের তিনটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা পাহাড়গুলোর মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। ওইসব পাহাড়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। আর এসব এলাকায় ঘর, বাড়ি ও বস্তি নির্মাণের বিষয়ে আপত্তি ও অনাপত্তি বিষয়টি দেখার দায়িত্ব গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এই তিন মন্ত্রণালয় কখনও পাহাড়গুলোর খোঁজ খবর রাখেনি। তাদের উদাসীনতার সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু মহল পাহাড় দখল করে সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালি মাটি বেশি। ফলে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে এক শ্রেণির চিহ্নিত ভূমিদস্যু পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। যারা পাহাড় দখল করে স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে ভাড়া আদায় করে। তারা বিভিন্ন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনের লোকজনকে দেখি বছরের ১০ মাস পাহাড় নিয়ে নীরব থাকেন। শুধু মে-জুন এলে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের নিয়ে কথা বলেন। পাহাড়ে যারা অবৈধভাবে বসবাস করেন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একটা শ্রেণি চায় না অবৈধ বসবাসকারীরা পাহাড় থেকে নেমে আসুক। নেমে আসলে পাহাড় দখলের প্রক্রিয়াটা থেমে যাবে। এ কারণে পাহাড়ে যারা অবৈধ স্থাপনা তৈরির সঙ্গে জড়িত তাদের নিবৃত্ত করতে হবে। তা না করা গেলে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকবে। আর পাহাড়ধসে মারা যাবে নিম্নআয়ের মানুষ’।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘পাহাড় ধস রোধে রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু এটি নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর উচ্ছেদ করি। আমরা আমাদের যেটি করার সেটি সব সময় করছি। অন্যরাও যদি নিজেদের জায়গা থেকে সঠিক ভূমিকা পালন করে, তবেই কেবল এটি রোধ করা যাবে। অন্যথায় আমরা সারা বছর অভিযান চালিয়েও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রোধ করতে পারবো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্গম পাহাড়ে যদি পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকে তাহলে লোকজন অব্যশই পাহাড়ে থাকতে চাইবে। যাদের পক্ষে বাসা ভাড়া নেওয়া সম্ভব না, তারা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পাহাড়ে বসবাস করবে। যেসব প্রতিষ্ঠান সার্ভিস লাইনগুলো সরবরাহ করে, তাদের এগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি এখন যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে তাদের সরিয়ে নিতে একটি স্থায়ী পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর তখনই পাহাড়ে আর কেউ থাকবে না।’
এ লক্ষ্যে সিডিএ স্থায়ী পুর্নবাসনের জন্য একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। সেটি বাস্তবায়ন করা হলে তখন আর কেউ পাহাড়ে বসবাস করতে পারবে না। সবাইকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন