ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনী সহিংসতায় পুলিশের গুলিতে নিহত শিশু কন্যা আশার জানাযা সম্পন্ন!
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের একটি ভোটকেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণার পর পুলিশের গুলিতে ১০ মাস বয়সী এক শিশু নিহত হয়েছে।
বুধবার (২৭ জুলাই) সন্ধ্যা ৭টার দিকে ৫ নম্বর বাচোর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিশুটির নাম সুরাইয়া আক্তার আশা। সে মীরডাঙ্গী গুচ্ছগ্রাম এলাকার বাদশার আলীর মেয়ে। ওই কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা পুলিশের ওপর হামলা চালান। তখন পুলিশ হামলা ঠেকাতে গুলি ছোড়ে। শিশুটি তখন মায়ের কোলে ছিল। নিহত শিশুর মা মিনারা বেগম বলেন, আমি মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ সময় পুলিশের গুলি আমার মেয়ের মাথায় এসে লাগে। গুলিতে তার মাথার খুলি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়।
এ ঘটনায় বুধবার রাতে রাণীশংকৈল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম জাহিদ ইকবালসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বাচোর ইউনিয়নের খুটিয়াটুলি এলাকায় কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন উত্তেজিত জনতা। রাণীশংকৈল থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুল লতিফ শেখ জানান, এ ঘটনায় রাণীশংকৈল থানার ওসি, এক এসআই ও এক কনস্টেবলকে অবরুদ্ধ করে রাখেন স্থানীয়রা। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে আনেন। পরে দুই পুলিশ সদস্যকে চিকিৎসার জন্য ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশু মারা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন উত্তেজিত জনতা।
এ ঘটনায় পৌরশহরের শিবদিঘী যাত্রী ছাউনি মোড় অবরোধ করে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। স্থানীয়রা এর প্রতিবাদে ওই এলাকার আঞ্চলিক সড়কটি কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন।
পরে আরো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে তারা একসময় পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। এসময় পুলিশের একটি মাইক্রোসহ দুজন পুলিশকে বেধড়ক মারধর করেন উত্তেজিত জনতা। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) ইন্দ্রজিত সাহা’র নেতৃত্বে দুই গাড়ি বিজিবি ও পুলিশ সদস্যসহ ফের রানীশংকৈল থানার ওসিসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে।
এদিকে উদ্ধরকৃতদের নিয়ে ফেরার পথে উত্তেজিত জনতা নিহত শিশুর মরদেহ নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং থানা ঘেরাও করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এরপর বিজিবির একটি দল থানার সামনে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ওই ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. খতিবর রহমান বলেন, সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত শান্তিপ‚র্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ শেষ হয়। পরে গণনা শেষে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের উপস্থিতিতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে ইউপি সদস্য পদে বাবুল হোসেন ৪৯৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আজাদ আলী পেয়েছেন ৪৪২ ভোট ও খালেদুর রহমান পেয়েছেন ২৪৫ ভোট। খতিবর রহমান জানান, ভোটের ফলাফল ঘোষণা করার পর কেন্দ্র থেকে ইভিএম মেশিন ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসে চলে আসা হয়।
“ইউপি সদস্য প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলিও করেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছ, ভোট গণনা শেষে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ফলাফল ঘোষণার পর পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা পুলিশের ওপর হামলা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে স্থানীয় মো. বাদশা নামের এক ব্যক্তির মেয়ে সুরাইয়া আক্তার আশা মায়ের কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শিশুটি মারা যায়। গুলিতে আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ফিরোজ আলম বলেন, নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় আহত ১১ ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
তবে তাঁদের মধ্যে কতজন বাচোর এলাকার, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। মেয়েটির মা মিনারা বেগম তিনিও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। রানীশংকৈল থানা পরিদর্শক (ওসি) এসএম জাহিদ ইকবাল মুঠোফোনে জানান, নির্বাচনের দাঁয়িত্বরত কর্মকর্তাদের নিরাপদ রাখতে পুলিশ গুলি ছুড়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার মোহা. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নির্বাচন কেন্দ্রের ফলাফল শেষে যখন তারা কেন্দ্র ত্যাগ করার সময় পরাজিত মেম্বার প্রার্থীদের থেকে আমাদের মোবাইল টিম ও সদর সার্কেলের ওপর হামলা চালানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠি চার্জ করে। জানমালের রক্ষার্থে পুলিশ ৪রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়ে। আমাদের দুজন পুলিশ সদস্য আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় একটি শিশু মারা যায়। কীভাবে মারা গেল এটি এখনো জানা যায়নি। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহত শিশুটির মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর পাঠানো হবে। ময়নাতদন্ত করা ছাড়া এটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে পুলিশের গুলিতে শিশুটি মারা গেছে। তারপর আইনি প্রক্রিয়া শেষে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হবে।
রাণীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির বলেন, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোট গ্রহণের দাঁয়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ওপর হামলা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন সেখানে অ্যাকশনে যায়। শিশুটির ময়নাতদন্তের পর ঘটনার বিস্তারিত বলা যাবে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আমরা তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছি। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবেন। নিহতের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে সব ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন । আজ বিকাল ২টা ২০মিনিটে মীরডাঙ্গী স্কুল মাঠে শিশুটির জানাযা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন