ঢাবি অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের ৭ মাসে যত ক্ষতি
পড়াশোনার গুণগত মান নিশ্চিত, সেশনজট কমানোসহ বেশকিছু সমস্যা নিরসনে ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ৭ কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এরপরও এসব কলেজে সময়মতো পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ হয়নি। একাডেমিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে, দেখা দিয়েছে সেশন জট। ঠিক সময়ে ফল প্রকাশ না হওয়ায় চাকরির অবেদন করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। তাই বাধ্য হয়েই তারা আন্দোলনে নামে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, গত সাত মাসে তাদের যেসব ক্ষতি হয়েছে তা পোষাবে কে?
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর থেকে চাপ কমাতে ২০১৪ সাল থেকে সরকার রাজধানীর বড় বড় কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়। তার বাস্তবায়ন হয় চলতি বছর জানুয়ারিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় এসব কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খুশিই হয়েছিলেন। তবে তা ম্লান হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। ঢাবির অধিভুক্ত হওয়ার পর থেকেই কলেজগুলোয় পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ স্থগিত রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ে তাদের স্নাতক পর্যায়ের ৩০টি বিষয়ের প্রথম থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত শতাধিক পরীক্ষার ফলাফল চূড়ান্ত করেছে।
ঢাবি কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশ না করতে পারার দায় চাপাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এজন্য ঢাবির ব্যর্থতাকেই দায়ী করছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্বে কেন আমরা ভুক্তভোগী হবো? আমার গত ৭ মাসে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি তা পোষাবো কি করে?
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৮ মার্চ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু তাদের হয়নি। প্রথম বর্ষের পরীক্ষাও হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলেও তাদের হয়নি। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা হয়নি এবং ডিগ্রি প্রথম ও তৃতীয় বর্ষ পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে।
তিতুমীর কলেজের ছাত্র ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় আমরা খুশিই হয়েছিলাম। কারণ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকার সময়ে সেশনজট ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় ভেবেছিলাম সবকিছুর আমূল পরিবর্তন হবে। কিন্তু গত ৭ মাসে যে ক্ষতি হলো তা পোষানো কঠিন হবে।’
তিনি বলেন, ‘চতুর্থ বর্ষের ফল ও মাস্টার্সের পরীক্ষা না হওয়ায় ৩৮তম বিসিএসসহ অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষায় আবেদন করতে পারিনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সেশনের শিক্ষার্থীদের চেয়ে আমরা পিছিয়ে পড়েছি কয়েক ধাপ।’
ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী বিউটি আক্তার বলেন, ‘আমরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আজ রাস্তায় পড়ে আছি। সামনে বিসিএস পরীক্ষা। অনার্সের ফল প্রকাশ না হওয়ায় আবেদন করতে পারিনি। বিসিএস কোচিং করি তারও আন্দোলনের জন্য বন্ধ রেখেছি। বাবা টাকা খরচ করে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছেন, টাকাটাও তো জলে গেল।’
উদ্ভূত এ সমস্যা নিরসনের জন্য মার্চ থেকেই আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে নিজ নিজ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা, পরে ছোট ছোট কর্মসূচি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। এতে টনক না নড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেন তারা। ঢাবি উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন। তারপরও ঢাবি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও আশ্বাস পায়নি তারা। পরে বাধ্য হয়ে ২০ জুলাই শাহবাগে সমাবেশের ডাক দেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি দেয়। ওই কর্মসূচিতে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের আঘাতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের চোখ নষ্ট হওয়ার হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের সমন্বয়ক রাছেল সরকার বলেন, ‘সিদ্দিকুরের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল মেরে তার চোখের ক্ষতি করেছে। সে দেখতে পাওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সে যদি চোখে দেখতে না পায় তাহলে এই ক্ষতি কে পোষাবে? সিদ্দিকুরের সব দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।’
এ সমস্যা ঢাবি উপাচার্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট বলে মনে করেছেন অনেকেই। তবে সমস্যার সমাধান হয়েছে উল্লেখ করে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সাত কলেজ নিয়ে যে সমস্যা হয়েছিল তার সমাধান হয়েছে। পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। অপ্রকাশিত ফল দ্রুত প্রকাশ করা হবে।’
লোকবল সংকট কি সমস্যার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ ৭টি কলেজের দায়িত্ব নেওয়া তো একটা চাপের। তবে লোকবল সংকট নেই আমাদের। সংকট থাকলে তো অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে জানাবো।’
৭ মাসে যত ক্ষতি হলো শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি কি পোষানো সম্ভব—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি ক্লাস নেওয়া হবে। দ্রুত পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ করা হবে।’ তবে এই আন্দোলন করানোর পেছনে কেউ ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, ২২ জুলাই ঢাবি উপাচার্য ৭ কলেজের অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষার্থী নিয়ে সমস্যা সমাধান বিষয়ে বৈঠক করেন। সেখানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ করেন। যখন যে তথ্য চাওয়া হয়েছে তারা সময় মতো দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়। পরে ২৩ জুলাই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতি দেয়।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন যে তথ্য চেয়েছে তখন সেই তথ্য দিয়েছি। বরং সিডি আকারে তাদেরকে দিয়েছি। যদি হার্ড কপি দিতাম তাহলে সিডি বানাতেও আরও দু’বছর সময় লাগাতো। এখন এর দায় কেন আমাদেরকে দেবে। তারা এটা পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ৭ মাস ধরে এই সমস্যা চলছে। ৭ মাস কি কম সময়? এর মধ্যে কেন সমাধান করতে পারলো না? তারা একটা ওয়েবসাইটও বানাতে পারেনি যা একদিনের কাজ। আমরা শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সবধরনের সহযোগিতা করেছি।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখনও অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) অপ্রকাশিত ফল প্রকাশ, পরীক্ষার রুটিন ঘোষণা, ৭ কলেজের জন্য আলাদা ওয়েব সাইট নির্মাণ, আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি, সিদ্দিকুরের চিকিৎসার ভার নেওয়া, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করার আল্টিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এগুলো মেনে না নিলে আবারও আন্দোলনে যাবে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে ইডেন কলেজ আন্দোলনের সমন্বয়ক নবিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছি। আমাদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন