ঢামেকের মর্গে রাখা শিশুর মুখাংশ খেয়ে ফেলল ইঁদুর

‘বাবুটা মইরা গিয়াও শান্তি পাইল না! মরার অাগেও কষ্ট পাইল, মরার পরও কষ্ট পাইল। বাপ হইয়্যা এমন কষ্ট নিজ চোখেই দেখতে হইল। এত দৌড়াদৌড়ি কইরাও পারলাম না বাবুটারে রক্ষা করতে। এত অনুরোধ করলাম ছেলেটারে না কাটার লাইগ্যা, কিন্তুু তারপরও…!’

কথাগুলো বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সোহান নামে দেড় বছর বয়সী এক শিশুর বাবা সোহাগ হাওলাদার। কারণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর তার ছেলেকে রাখা হয় মর্গের হিমঘরে। তার অভিযোগ, সেখানে রাখার মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই শিশুটির মুখের বাম অংশের উপরের চোয়াল ও কানের মাংস খেয়ে ফেলেছে ইঁদুর। যে কাটা-ছেঁড়ার ভয়ে শিশুকে ময়নাতদন্ত করতে দেননি, সেই কাটা-ছেঁড়ার ঘটনায় ঘটল শিশুটির দেহ। এটি বাবা হিসেবে তিনি মনে নিতে পারছেন না।

গত ২৫ এপ্রিল দুপুর অাড়াইটার দিকে গরম ডাল পড়ে শিশুটির গায়ে। দগ্ধ অবস্থায় বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তাকে নিয়ে অাসা হয় হাসপাতালে। ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে টানা ৮ দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চিকিৎসকদের সকল চেষ্টা উপেক্ষা করে না ফেরার দেশে চলে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের অাইসিইতে চিকিৎসাধীন দেড় বছরের শিশু সোহান হাওলাদার। নিয়মানুযায়ী শিশুটির মৃত্যুর পর ময়নাতদন্তের কথা ছিল। কিন্তুু শিশুটির পরিবার রাজি ছিল না ময়নাতদন্তের জন্য। কারণ ময়নাতদন্তে মরদেহের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কাটা হয়। তাই তারা ঢামেকের সংশ্লিষ্টদের নিকট শিশুটিকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন।

সংশ্লিষ্টরাও ময়নাতদন্ত ছাড়া শিশুটিকে নিয়ে যেতে পারবে বলে তাদেরকে অাশ্বাস দেন। এ জন্য তাদের এলাকার থানা পুলিশের অনুমতি অানার পরামর্শ দেন স্বজনদের। স্বজনরাও অনুমতির জন্য ছুটে যান থানায়। অনুমতিপত্র অানা পর্যন্ত শিশুটির মরদেহ যেন সুরক্ষিত থাকে এ জন্য শিশুটির মরদেহ রাখা হয় ঢামেকের জরুরি বিভাগের মর্গের হিমঘরে। কিন্তুু পুলিশের অনুমতিপত্র এনে যখন হিমঘর থেকে শিশুটির মরদেহ নিতে অাসলো স্বজনরা তখন তারা দেখতে পান শিশুটির মুখের বাম অংশে ও কানের চারপাশে রক্ত ঝরছে। সেখানে কোনো মাংস নেই। পরে তারা বিষয়টি ঢামেকের সংশ্লিষ্টদের জানালে তারা জানায়, হিমঘরে রাখার পর সেখানে ইঁদুর অথবা বেজি মাংসগুলো খেয়ে ফেলেছে।

নিহত শিশুর বাবা সোহাগ জানান, অাজ সকাল সাড়ে ৯টায় বার্ন ইউনিটের আইসিইউর পাঁচ নম্বর বেডে মারা যায় তাদের শিশু সোহান। এরপর তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে চাইলে চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত ছাড়া ছাড়পত্র দেয়নি। কিন্তুু তারা ময়নাতদন্ত করবেন না বলে জানান চিকিৎসকদের। এ জন্য তাদেরকে স্থানীয় গুলশান থানা থেকে ময়নাতদন্ত না করার অনুমতিপত্র অানার জন্য পাঠান। দুপুর ১২টার দিকে তাদের শিশুর মরদেহ সুরক্ষিত রাখতে ঢামেক কর্তৃপক্ষ জরুরি বিভাগের মর্গের হিমঘরে রাখে।

তিনি অারও জানান, অনুমতিপত্র নিয়ে গুলশান থানা থেকে তারা এসআই অানোয়ারুল অালমকে সঙ্গে নিয়ে ঢামেকে অাসেন। কিন্তুু শিশুটিকে মর্গের হিমঘর থেকে বের করে নেয়ার সময় তারা দেখেন তাদের শিশুর মুখের বাম পাশের মাংস নেই। সেই স্থানে তাজা রক্ত ঝরছে। এটা দেখে তারা হতভম্ব হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে মর্গের সংশ্লিষ্টদের কাছে বিষয়টি তারা জানতে চাইলে তাদেরকে জানানো হয়, ইঁদুর অথবা বেজি শিশুটির মাংস খেয়ে ফেলেছে। হিমঘরের ফ্রিজের ভেতর এমন ঘটনা এর অাগেও একাধিকবার ঘটেছে বলে জানায় তাদেরকে।

এসআই ফারুক জানান, শিশুটির স্বজনরা থানায় অনুমতিপত্রের জন্য অাসলে থানা থেকে অামাকে পাঠানো হয় ঢামেকে। এখানে এসে মরদেহ হিমাগার থেকে বের করে দেখি তার বাম পাশের গালে ক্ষত। ওই ক্ষতস্থানটি ছিল রক্তাক্ত। মনে হচ্ছে হিমাগারের দরজা খোলা ছিল। শিশুটির গাল সম্ভবত ইঁদুরে খেয়েছে। এটা অব্যবস্থাপনার জন্যই হয়েছে।

বিষয়টি ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিনকে জানানো হলে তিনি এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি খুব বেদনাদায়ক, কেন শিশুটির গালে ক্ষত হলো! যারা এই বিভাগের হিমাঘরের দায়িত্বে আছেন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে, ভবিষ্যতে যেন এমন দুঃখজনক ঘটনা আর না ঘটে।

নিহতের বাবা সোহাগের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কনকদিয়া এলাকায়। তিনি পেশায় পাঠাওয়ে রাইড শেয়ারিংয়ের কাজ করেন। স্ত্রীর নাম মীম অাক্তার। শিশু সোহান তাদের প্রথম ও একমাত্র সন্তান। তারা পরিবার নিয়ে রাজধানীর গুলশানের নর্দা এলাকার ৫/৬ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকেন।