তরুণীরা ‘টিকটক স্টার’ হওয়ার ফাঁদে ভারতে পাচার হন

টিকটক গ্রুপ খুলে সেখানে পোস্ট করা হতো আকর্ষণীয় ভিডিও। সেই ভিডিওতে যেসব মেয়ে লাইক-কমেন্ট বা শেয়ার করতেন প্রথমে তাদের টার্গেট করা হতো। যারা টার্গেট করতেন তাদের টিকটক আইডিতে লাখ লাখ ফলোয়ার থাকত। পরে দেখানো হতো ভিডিও তৈরি করে টিকটকে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর প্রলোভন।

একপর্যায়ে ভার্চুয়াল মাধ্যম থেকে সরাসরি সাক্ষাৎ করা হতো টার্গেট করা তরুণীদের সঙ্গে। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে নিয়ে তাদের দিয়ে টিকটক ভিডিও বানিয়ে করা হতো সুসম্পর্ক। নিরীহ তরুণীদের সঙ্গে সুসম্পর্কের পর তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন হোটেলে। সেখানে নাচ-গানসহ মাদকসেবনের অভ্যাস করানোর চেষ্টা করা হতো। বেঙ্গালুরুতে নির্যাতিত বাংলাদেশি তরুণী ছাড়াও অনেককে এভাবে টিকটকের ফাঁদে ফেলে ভারতে পাচার করা হতো। বাধ্য করা হতো দেহ ব্যবসায়।

যেসব মেয়ে পারিবারিকভাবে অসচ্ছল অথবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কিংবা ব্যক্তিগত কোনো সমস্যায় রয়েছেন ও চেহারা সুন্দর; মূলত তাদেরই টার্গেট করা হতো। পুরো এই চক্রের (টিকটকচক্র) প্রধান ছিলেন রিফাদুল ইসলাম ওরফে ‘টিকটক হৃদয়’। তাদের অন্যতম মূলহোতা ছিলেন আশরাফুল ইসলাম রাফি ওরফে বস রাফি। ভারতে বস রাফি নামেই তিনি পরিচিত। ঢাকা থেকে যে তরুণীকে ভারতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল- তাকে টিকটকের ফাঁদে ফেলেই পাচার করেছিলেন হৃদয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, টিকটকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এই প্রলোভনে পাচার শুরু হয়েছে। উঠতি বয়সী কিশোরী-তরুণীদের মডেল বা স্টার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে পাচার করছে একটি চক্র। এ জন্য টিকটককে তারা ‘নেগেটিভলি’ দেখছেন। টিকটককেন্দ্রিক অপচেষ্টা বন্ধে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, দেশে যারা টিকটক তৈরি করে তাদের একটি অংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। টিকটক তৈরির সুবাদে তারা প্রায়ই বিভিন্ন পার্টির আয়োজন করে। সেখানে কম বয়সী তরুণীদের নিয়ে যাওয়া হয়। টিকটকের মতো ড্যান্স পার্টির আড়ালেও চলে বিভিন্ন পার্টির আয়োজন। সেখানে ভিডিও বানিয়ে টিকটকে ছাড়া হয়। টার্গেট করা তরুণীদের বিয়ের ফাঁদে ফেলে ভারতে পাচার করা হতো। এছাড়া বেঙ্গালুরুতে যৌন ব্যবসায় বাংলাদেশি তরুণীদের চাহিদা বেশি থাকায় বিপুল অর্থের লোভে দেশের তরুণীদের পাচার করত টিকটকচক্র।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে এভাবে নারী পাচারচক্রের অন্যতম মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এলিট ফোর্সটি জানায়, ভারতে নারী পাচারকারী চক্রের মূলহোতা রাফির গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নাদপাড়ায়। প্রায় আট বছর ধরে তিনি নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত। গত আট বছরে তিনি প্রায় ৫০০ নারী পাচার করেছেন ভারতে। উদ্দেশ্য দেহ ব্যবসা।

র্যাবের গ্রেফতারের একদিন পরই ভারত থেকে দেশে ফেরা এক তরুণীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের মামলায় সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতাররা হলেন- মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের। যারা ভারতে প্রায় এক হাজার নারীকে পাচারে সীমান্ত পার হতে সরাসরি সহায়তা করেছেন।

পুলিশ বলছে, কৌশলে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোর করে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য বা পরিচিতদের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয় ভুক্তভোগী তরুণীদের। পাচারকারীচক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা এক তরুণীর করা মামলার এজাহারে ও তদন্তে উঠে এসেছে লোমহর্ষক বর্ণনা, যা করুণ কাহিনী কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।

জানা গেছে, অষ্টম শ্রেণি পাস বস রাফি আট বছর ধরে ভারতের বেঙ্গালুরুতে বসবাস করেন। সেখানে যাওয়ার পর তার অবস্থা ফুলেফেঁপে ওঠে। সেখানে (বেঙ্গালুরু) প্রথমে তিনি গাড়ি চালাতেন। পরে রেস্তোরাঁয় চাকরি শুরু করেন। সেখানে অবস্থান করার সময় বস রাফি তামিল ভাষা রপ্ত করেন। এতে বেঙ্গালুরুসহ ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে যারা অনৈতিক কার্যক্রম করেন তাদের অনেকের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। সম্প্রতি টিকটিক করার প্রলোভনে প্রায় ৫০ জনকে পাচার করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই রাফি। প্রতি নারীর পাচারের বিনিময়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতেন তিনি।

র্যাবের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, টিকটকের আড়ালে তরুণীদের বলা হতো- ‘তোমাদের মডেল তৈরি করা হবে। তোমরা স্টার হবা। তোমাদের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।’ এরপর সুসম্পর্ক গড়ে টিকটক ভিডিও তৈরি করা হতো। ভিডিও ভিউ হলে টাকা, তবে দেশে থেকে যে টাকা উপার্জন করা যায়- ভারতে গেলে এর বেশি টাকা উপার্জন করা যায়, এমন প্রলোভন দেখিয়ে কমবয়সী তরুণীদের ভারতে পাচার করা হতো। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এবং চেহারা সুন্দর মেয়েদের তারা টার্গেট করতেন। যারা নায়িকা বা স্টার হতে চান, এই ধরনের মেয়েদের সহজে টার্গেটে পরিণত করতে পারত চক্রটি। এছাড়া তরুণীদের ভারতে পাচারের আগে উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা ও মাদকাসক্তও করা হতো।

যেভাবে ভারতে তরুণীদের পাঠাতেন রাফি

মানবপাচারকারী বস রাফি তার চক্রের বিভিন্নজনের মাধ্যমে থেকে তরুণীদের ভারতে পাচার করতেন। সেখানে বাংলাদেশি তরুণীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাত চক্রটি। টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন রাফি। হৃদয়ের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন তরুণীকে ভারতে পাচার করেন তিনি। বৈধ-অবৈধ উপায়ে টিকটক হৃদয় ভারতে আসা-যাওয়া করতেন। সবশেষ দুই বছর আগে তিনি ভারতে পাড়ি জমান। নারী পাচারকারীচক্রের অন্যতম মূলহোতা রাফি একইভাবে ভারতে যাওয়া-আসা করেন। অবৈধ এসব কাজে দুই দেশের সীমান্তে দালালরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভারতে পাচার তরুণী জানালেন ‘ভয়ঙ্কর’ সব তথ্য

চাকরি দেয়ার কথা বলে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচিত হন টিকটক স্টার রিফাদুল ইসলাম হৃদয়। এরপর টিকটক হ্যাংআউটের জন্য কুষ্টিয়ায় যাওয়ার কথা বলে ওই তরুণীকে তিনি নিয়ে যান সাতক্ষীরায়। আর সেখান থেকে কৌশলে ভারতে পাচার করা হয় তাকে। ভারতের বেঙ্গালুরুতে নিয়ে ওই তরুণীকে হোটেল ও ম্যাসাজ পার্লারে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। টিকটক হৃদয়ের ফাঁদে পড়ে ভারতে পাচার হওয়ার পর ৭৭ দিনের এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের সময় পার করে গত মে মাসে কৌশলে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন ওই তরুণী। ওই তরুণী জানান, সেখানে অবস্থান করার সময় তিনি আরও অনেক বাংলাদেশি তরুণীকে দেখেছেন। যারা বিভিন্ন সময়ে এই চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়েছেন।

ফিরে এসে হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে হৃদয়সহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। তাদের তিন জনকে মঙ্গলবার (১ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা হলেন- মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদের। কীভাবে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় এবং কোন কৌশলে তাকে ফাঁদে ফেলে পাচার করা হয়, এর বর্ণনা মামলার এজাহারে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ওই নারী।

টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে যেভাবে পরিচয় এক তরুণীর

এক বান্ধবীর সঙ্গে হাতিরঝিলে ঘুরতে গেলে হৃদয় যেচে এসে পরিচিত হন ওই তরুণীর সঙ্গে। ওই তরুণী এজাহারে বলেন, ‘২০১৯ সালে মার্চ মাসের কোনো একসময় আমি আমার বান্ধবী আফরিনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে ঘুরতে যাই। আফরিনের বাসা মগবাজারে। এ সময় ২০-২৫ বয়সী পাঁচ-ছয় জন ছেলে আমাদের সামনে আসে। তাদের মধ্যে একজন আফরিনের সঙ্গে কথা বলে। তার নাম রিফাদুল ইসলাম হৃদয়। সে আফরিনের সঙ্গে দু-এককটা কথা বলে আমার পরিচয় জানতে চাইলে আফরিন আমাকে তার বান্ধবী বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। রিফাদুল ইসলাম হৃদয় আমার মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি চাইলে আমি দিতে অস্বীকৃতি জানাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাসখানেক পর রাজধানীর একটি অভিজাত শোরুমের বিক্রয়কর্মী নিয়োগ দেয়া হবে জেনে আমি চাকরিপ্রার্থী হিসেবে সেখানে যাই। রিফাদুল ইসলাম হৃদয়ও চাকরিপ্রার্থী হিসেবে সেখানে যায়। সেখানে সে আমাকে চিনতে পারে। আমার মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি চায়। আমি মোবাইল নম্বর দেই। ফেসবুক আইডি দেইনি।’

বিয়ের ফাঁদে ফেলে ভারতে নারী পাচার

এলিট ফোর্স- র্যাব জানায়, নারী পাচারকারীচক্রের সদস্যরা অনেক তরুণীকে বিয়ের ফাঁদে ফেলে ভারতে পাচার করতেন। ট্যুরিস্ট ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসার মাধ্যমে সীমান্ত পার হওয়ার সময় চক্রের সদস্যরা সঙ্গে থাকা তরুণীকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতেন। আর এই কাজে দেশের অংশে সহযোগিতা করতেন দেশীয় দালালরা। আর অপর পাশে ভারতীয় দালালরা। এর বাইরেও অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বেশির ভাগ তরুণীকে পাচার করা হয়েছে। এই চক্রটির মাধ্যমে ৫০০ তরুণীকে পাচার করা হয়েছে। তবে যাদের মধ্যে অনেকে আবার দেশে ফিরেও এসেছেন।

তরুণীকে যে কারণে বিবস্ত্র করে নির্যাতন

টিকটকের মডেল তৈরির প্রলোভনে নির্যাতিত তরুণীসহ আরেকজনকে ভারতে পাচার করেন হৃদয়। এরমধ্যে এক তরুণীকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সহযোগিতা করেন নির্যাতনের শিকার তরুণী। এ কারণে ওই তরুণীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। বলা হয়, এরপর আর কাউকে দেশে ফিরে যেতে সহযোগিতা করা হলে তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিওটি ভাইরাল করে দেয়া হবে।

বেঙ্গালুরুতে যৌন ব্যবসায় বাংলাদেশি তরুণীদের ব্যাপক চাহিদা

ভারতের বেঙ্গালুরুতে যৌন ব্যবসায় বাংলাদেশি তরুণীদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বেঙ্গালুরুতে পাচার হওয়া অনেক বাংলাদেশি নারীকে দিয়ে সন্তানও নেয় তারা। আর পাচার হওয়া নারীদের ঘণ্টা বা দৈনিক চুক্তিতে দেহ ব্যবসা করানো হতো। সপ্তাহ, মাস বা বছর চুক্তিতে খদ্দেরের কাছে পাঠানো হতো। যারা চুক্তি করতেন তারা নিজেদের বাড়িতে নিয়েই রাখতেন এসব তরুণীকে।

পাচার নারীদের দিয়ে যেভাবে আয় করত চক্রটি

পাচারকারীচক্রের অন্যতম মূলহোতা বস রাফি ভারতে পাচার মেয়েদের একটি অংশকে সেখানকার বিভিন্ন যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দিতেন। আর অন্যদের তার নিয়ন্ত্রণে রেখে দেহ ব্যবসা করাতেন। বাংলাদেশে বসে কিংবা ভারতে বসে রাফি এসব টাকার ভাগ পেতেন। এই টাকা দিয়ে রাফি নিজ এলাকা ঝিনাইদহে জায়গা-জমি কিনেছেন। এছাড়া গাড়ির গ্যারেজ করেছেন। এর বাইরে ভারতে তার বাড়ি রয়েছে বলেও জানা গেছে। ভারতে দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে সেখানে আধার কার্ডও রয়েছে তার।

কে এই বস রাফি

বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। আট বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার যাতায়াত শুরু হয়। তিনি সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার, রিসোর্ট কর্মচারী হিসেবে ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি নারী পাচারে জড়িত। দুই বছর আগে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক তরুণীকে পাশের দেশে পাচার করেছেন বস রাফি। টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্যান্য এজেন্ট রয়েছে।

সম্প্রতি ভারতে এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই তরুণীকে ভারতে পাচার করেন টিকটক হৃদয়। বস রাফি তাকে গত বছরের অক্টোবরে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে একটি সেফ হাউজে রাখেন। সেখানেই ভিডিওটি ধারণ করা হয় বলে জানা যায়। বেঙ্গালুরুতে বস রাফির বেশ কয়েকটি সেফ হাউজ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তার সেফ হাউজ রয়েছে। এরমধ্যে ‘ম্যাডাম সাহিদার সেফ হাউজ’ অন্যতম।

ভারতের সীমান্ত দেখানোর ফাঁদ

দেশে পালিয়ে আসা এক তরুণীকে টিকটক হ্যাংআউটের নামে প্রথমে কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পরদিন সকালে ৫০-৫৫ বছর বয়সী এক লোক ছয়জনের নাস্তা নিয়ে আসেন। তার নাম আব্দুল কাদের। তিনি জানান, সামনেই ভারতের বর্ডার। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য নাকি খুব সুন্দর। এই এলাকায় এলে কেউ সেখানে না ঘুরে ফেরেন না বলে জানান কাদের।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পাচার হওয়ার পর দেশে ফেরত আসা তরুণী বলেন, ‘আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। একটু পরেই হৃদয় এসে আব্দুল কাদেরকে বলল, ভারতীয় বর্ডার কতদূর, সেখানে ছবি তোলার মতো ভালো কোনো দৃশ্য আছে কি-না। আদুল কাদের হৃদয়কেও একইভাবে জানালো, সেখানকার দৃশ্য খুব সুন্দর। ছবি তোলার জন্য অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে সেখানে যায়।’

তিনি বলেন ‘যেহেতু হৃদয় টিকটক করে, সে ভারতীয় বর্ডারের কাছে গিয়ে ছবি তুলতে চায়, আমাকে তার সাথে যেতে অনুরোধ করে। আব্দুল কাদেরকে অনুরোধ জানায়, ভারতীয় বর্ডারের কাছাকাছি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য। আব্দুল কাদের আমাদের ভারতীয় বর্ডারের খুব কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেয়।’

সীমান্তের পথে যাত্রা শুরু

দুপুর ১২টার দিকে আব্দুল কাদের দুই সেট ছেঁড়া জামা-কাপড় নিয়ে এসে দুই তরুণীকে পরতে বলেন। ছেড়া জামা-কাপড় না পরলে নাকি ভেতরে যাওয়া যায় না। ওই তরুণী বলেন, ‘প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর দুটি লাল মোটরসাইকেল নিয়ে ২৫-৩০ বছর বয়সী দুজন পুরুষ লোক আসে। তাদের নাম মেহেদী হাসান বাবু ও মহিউদ্দিন। বাবুর বাবার নাম আব্দুল কাদের। এরপর হৃদয়, ভুক্তভোগী তরুণী, লাবণী (ছদ্মনাম), লাবণীর সঙ্গে আসা তিন তিনজন- মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের সীমান্তের দিকে হাঁটতে থাকেন।

ওই তরুণী আরও বলেন, ‘১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর এক জায়গায় দেখি, আমার বয়সী চারজন মেয়ে ও ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক পুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার নাম হারুন। সেখানে থাকা আরেক যুবক আনিস সালাম দিয়ে আমাদের বলে, সামনে কোনো সমস্যা হবে না। সে বলে রেখেছে। মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও হারুনকে আনিস নির্দেশ দেয় আমরা যেন সহি-সালামতে সেখানে ঘুরতে পারি। মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও হারুনের সঙ্গে হৃদয়সহ আমরা ছয়জন হাঁটতে থাকি। ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার পর ভারতীয় বর্ডারের সামনে আমরা বসে থাকি। হৃদয় আমাকে জানায়, ভারতীয় সীমানায় ঢুকে সে আমার সাথে সেলফি তুলবে।’ এভাবেই তাদের কৌশলে ভারতে পাচার করা হয়।

নজরদারিতে টিকটকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপ

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘টিকটকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এই পাচারকেন্দ্রিক অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। উঠতি বয়সী কিশোরী-তরুণীদের মডেল বা স্টার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে পাচার করছে একটি চক্র। এ জন্য আমরা টিকটককে আমরা নেগেটিভলি দেখছি। টিকটককেন্দ্রিক অপচেষ্টা বন্ধে আমরা জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পাচারের শিকার ও পাচারকারীরা অবৈধভাবে ভারতে যায়। তাদের কাছে ভিসা-পাসপোর্ট বা কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র থাকে না। এরপর চক্রের ভারতীয়দের সহায়তায় সে দেশের আধার কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়। যে কার্ড ব্যবহার করে তারা ভারতে মুভমেন্ট করে থাকেন। তদন্তের এ পর্যায়ে আমরা অনেকের নাম পেয়েছি। তদন্তের আরেকটু পর সংখ্যাটি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব।’

র্যাবের ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা) উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘পাচারকারীদের ধরতে ঢাকাসহ সারাদেশে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। র্যাব একটি চক্রকে ধরেছে যারা ইতোমধ্যে ভারতে প্রায় ৫০০ নারী পাচার করেছে। ওই চক্রের অন্যান্য সদস্যদেরও গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘নারীদের সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে প্রেরণ করা হতো। এর পরের ধাপে কলকাতা থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু পাঠানো হতো। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর গ্রেফতার বস রাফি তাদের গ্রহণ করে বিভিন্ন সেফ হাউজে অবস্থান করাত। পরে ব্ল্যাকমেইল ও মাদকে অভ্যস্তকরণ এবং নির্যাতনের মাধ্যমে যৌন পেশায় বাধ্য করানো হতো। ভারতের এজেন্ট প্রত্যেক খদ্দের প্রতি তরুণীদের ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিত। ক্ষেত্রবিশেষে নারীদের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হতো।’

তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে এ চক্রের মূলহোতা বস রাফিসহ চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তাদের চক্রে আরও যারা রয়েছে এবং অন্য চক্রের সদস্যদেরও র্যাবের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘ভারতে নারী পাচার ঠেকাতে সবাইকে সচেতন থাকা জরুরি। বিশেষ করে মেয়েটির পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে নারী পাচার রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক সংগঠন, মসজিদ, মন্দিরসহ সভা সেমিনারে নারী পাচার রোধে আলোচনা করতে হবে।’ পাচারকারী সন্দেহ মনে হলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে দেশবাসীকে অনুরোধ জানান তিনি।