তীব্র বাধার মুখেও খাগড়াছড়ির ইউপিডিএফ এর দুই যুগপূর্তি পালিত

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বাংলার পাশাপাশি চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা ভাষায় ধারা বর্ণনা তীব্র বাধার মুখেও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার দুই যুগপূর্তি পালিত হয়েছে। সেনা ও পুলিশের মারমুখী অবস্থান গ্রহণ ও পাড়া-গ্রামের অভ্যন্তরে হুমকিমূলক টহলের মধ্যে সোমবার(২৬শে ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে নয় টায় জেলা সদরে ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত নির্ধারিত অনুষ্ঠান সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

পরিকল্পিতভাবে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে একটি চৌকস দল কর্তৃক দৃপ্ত কদমে দু’টি সুসজ্জিত তোরণ(দুই যুগের প্রতীক ১৯৯৮-২০২২) অতিক্রম করে দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং অংশগ্রহণকারীগণের স্যালুট প্রদানের মাধ্যমে দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এ সময় ছোট ছোট পতাকা হাতে দু’শতাধিক উৎফুল্ল শিশু-কিশোর ‘লঙ লঙ, লঙ লিভ ইউপিডিএফ’ ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানায়, এতে অনুষ্ঠানে সমবেতরা সংগ্রামী প্রেরণায় আন্দোলিত হয়। অনুষ্ঠানস্থল উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
পতাকা অভিবাদন জানানো শেষে মঞ্চের মাঝখানে বিশেষভাবে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ইউপিডিএফ-এর খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের পক্ষে চৌকস টিমের সদস্য সংঘ মিত্র চাকমা ও কর্নিয়া চাকমার পুষ্পস্তবক অর্পণের পরে অংশগ্রহণকারী সকলে একে একে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিশ্বের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গকারী সকল বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে সাইরেন বাজিয়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। নিরবতা পালন শেষে অংগ্য মারমার পরিচালনায় পার্টি, গণফ্রন্ট ও স্থানীয়রা লড়াই সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাতে প্রতিজ্ঞা করেন।

‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসনই মুক্তির পথ! শাসকচক্রের পাতানো ফাঁদ থেকে সাবধান, মনোহারী আশ্বাস-প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত হবেন না! জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইউপিডিএফ-এর পতাকাতলে সমবেত হোন, লড়াই জোরদার করুন’ শ্লোগান সম্বলিত বিশাল ব্যানারের পাদদেশে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দুই যুগপূর্তি অনুষ্ঠানের আরও বিশেষত্ব হচ্ছে, বাংলার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান তিন ভাষায়(চাকমা-মারমা ও ত্রিপুরা) ধারা বিবরণীয় দেয়া হয়। দুই যুগ(১৯৯৮-২০২২) সময়ক্রম বোঝাতে সুশোভিত দৃষ্টিনন্দন দু’টি তোরণ নির্মিত হয়। সমাবেশ স্থলে রঙিন পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙানো ছিল।

সংক্ষিপ্ত সমাবেশের শুরুতে ইউপিডিএফ কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার লিখিত বার্তা পড়ে শোনানো হয়। কর্মীবাহিনী ও জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া বার্তায় প্রসিত খীসা বলেন,“১৯৯৮ সালের ২৬শে ডিসেম্বরের আগের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পরের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিন্ন।” বার্তায় তিনি দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচি ভেস্তে দিতে সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার অপতৎপরতাকে সমালোচনা করে বলেন, ২৬শে ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ছাত্র-যুবসমাজ কর্তৃক সেতু-পুল নির্মাণ, পাড়া-গ্রাম, হাটবাজার ও রাস্তাঘাট পরিষ্কার অভিযান, পরিবেশ রক্ষার্থে পলিথিন-প্লাস্টিক কুড়িয়ে পোড়ানো, গণশৌচাগার নির্মাণ, যা ইতিপূর্বে ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার তা স্বতঃস্ফূর্ত ও সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

পোস্টার ছিঁড়ে দেয়া, ওঁৎ পেতে থেকে পোস্টারিং-এর টিমের ওপর হামলা, দেয়াল লিখন মুছে দেয়া, সেতু উদ্বোধনে বাধা প্রদান, সদ্য নির্মিত টয়লেট ধ্বংস করে দেয়ার মতো অসভ্য ঘৃণ্য কাজও হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়ার কথাও তিনি তার বার্তায় উল্লেখ করেন।

ইউপিডিএফ-এর পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানার সেনা কর্মকর্তাদের নিকট বুলেট-বোমার চেয়েও আতঙ্কের ব্যস্ত মন্তব্য করে বার্তায় ইউপিডিএফ সভাপতি বলেন, ভাড়াটে গুণ্ডা মাস্তান দিয়ে পোস্টারিং করতে যাওয়া ছাত্র-যুবকদের ওপর হামলা করার মধ্যে বাহাদুরি কিছু নেই। এতে দুর্নীতিগ্রস্ত সেনা কর্মকর্তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। এর ফলে ইউপিডিএফ-এর পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন’এর শক্তি ও কার্যকরিতা ক্ষুণ্য হবে না, বরং আরও বাড়বে। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত ভীরু সেনা কর্মকর্তাদের নিকট ইউপিডিএফ-এর পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানার বুলেট-বোমার চেয়েও আতঙ্কের ব্যস্ত, সেটা তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণ দিচ্ছে।

প্রদত্ত বার্তায় প্রসিত খীসা আরও বলেন, পাহাড়ের যুব-জনতা পোড় খেয়ে আরও অভিজ্ঞ ও সমৃদ্ধ হয়ে নিজেদের পাড়া-গ্রামকে আদর্শ গ্রামে পরিণত করবে। বিজয় অর্জনের ভিত্তি গড়ে তুলবে। বাধা দিয়ে হামলা করে ছাত্র-যুব-জনতাকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের শিশু-কিশোরদের মনে যে চেতনার আগুন জ্বলছে, তা কখনও নিভিয়ে দেয়া যাবে না।

সভায় খাগড়াছড়ি ইউনিটের সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের একমাত্র মুক্তির পথ। পার্বত্যবাসীকে এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে দাবি আদায়ের সংগ্রামকে বেগবান করে সু-সংগঠিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে।

অংগ্য মারমার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ইউপিডিএফ-এর দুই যুগ পূর্তি অনুষ্ঠান বানচাল করে দিতে সেনাবাহিনী সহ রাষ্ট্রের সকল সংস্থা হুমকিমূলক তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। গ্রামে গ্রামে টহল দিয়ে মারমুখী অবস্থান নেয়। স্বনির্ভর এলাকাসহ খাগড়াছড়ি সদরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশ মোতায়েন ছিল। কোথাও যাতে নির্বিঘেœ সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে না পারে, সে লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলের ভিতরে সেনা টহল অভিযান পরিচালিত হয়।

এত কড়াকড়ির মধ্যেও জনগণের সমর্থন ও সহায়তা নিয়ে ইউপিডিএফ-এর দুই যুগপূর্তি অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে। স্বনির্ভর এলাকা থেকে বেলুন উড়ানো হয়। নিরাপত্তা ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় নিয়ে মূল অনুষ্ঠানস্থলে নির্ধারিত কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করা হয়। সেনা টহল ও মারমুখী অবস্থানের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের পরে বেলুন উড়ানো হয়। সংগীতানুষ্ঠানও খুবই সংক্ষিপ্ত করা হয়।