দলে শৃঙ্খলা ফেরানোর দাবি আ.লীগের তৃণমূল নেতাদের

দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা এনে দিতে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি তুলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। তারা বলেছেন, দলের মধ্যে শৃঙ্খলা এনে দিলে ‘শেখ হাসিনার সরকার, বার বার দরকার’ এই শ্লোগানও আর দিতে হবে না।

শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সারাদেশ থেকে আসা তৃণমূল নেতারা এ দাবি তোলেন। তারা বিভিন্ন জেলার রাজনৈতিক চিত্র, দলের ভেতরে বিভিন্ন অসঙ্গতি, এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের দূরত্ব, দলের ভেতরে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। দলীয় মুখপাত্র নিয়েও কথা বলেন তৃণমূল নেতারা।

এর আগে বিশেষ বর্ধিত সভা ২০১৭ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। এসময় তিনি সদস্য সংগ্রহ, নবায়ন কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেন। বর্ধিত সভায় প্রত্যেক জেলার দলীয় কার্যালয়ে ব্যবহারের জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ল্যাপটপ উপহার দেন। এগুলো তৃণমূল নেতাদের হাতে তুলে দেন শেখ হাসিনা। এরপর তৃণমূল থেকে আসা ৮ বিভাগের ৮ জন নেতা বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনা মঞ্চে বসে থেকে সবার বক্তব্য শোনেন। পরে সবার অভিযোগ, অনুযোগ ও পরামর্শের জবাব দেন তিনি। রুদ্ধদ্বার এই সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

খুলনা জেলার সভাপতি হারুন উর রশীদ বলেন, দলের মধ্যে শৃঙ্খলা এনে দিলে ‘শেখ হাসিনার সরকার, বার বার দরকার’ এই শ্লোগানও দিতে হবে না। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দেখেছি আপনি (শেখ হাসিনা) মনোনয়ন দেন। কিন্তু নৌকার বিরুদ্ধে আরেক জন দাঁড়িয়ে যায়। তাই শৃঙ্খলা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দলের বিরুদ্ধে যদি আমিও যাই, আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।

তিনি বলেন, আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলায় সহযোগী সংগঠনের কমিটি হয় অথচ আমি জানি না। সহযোগী সংগঠনের সবাই কমিটি দেন ঢাকায় বসে।

তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুযোগের সুরে বলেন, ‘‘কয়দিন আগে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও এস এম জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা বলি। তারা বলেন, ‘দেখছি।’ এরপর আরও সময় চলে যায়। এভাবেই চলছে সবগুলো সহযোগী সংগঠন। তিনি বলেন, দলের স্পোকসম্যান (মুখপাত্র) যাতে একজন হয়। দলের সিদ্ধান্ত একজনই বলবেন। বেশি লোক দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বললে আমরা বিব্রত হই।’’

রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঝে মধ্যে এমন কথা বলেন, তখন আমরা ভীত হয়ে পড়ি। দল বুঝি আর ক্ষমতায় আসবে না। তাছাড়া উনার বক্তব্যে দলীয় বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠে।

তিনি বলেন, জেলার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কমিটি কিভাবে হয় আমরা জানি না। জেলা উপজেলার কমিটি ঢাকা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা জড়িত না থাকার ফলে জামায়াত, শিবির ও বিএনপির সক্রিয় নেতাকর্মীরাও আমাদের দলের জায়গা পেয়ে যায়। তিনি বলেন, এমপিরা নির্বাচিত হয়ে বলয়ের বাইরে যেতে পারেন না। আর বলয়ের কারণে অমুককে তমুককে দিয়ে কমিটি দেওয়া হয়। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়। তারা কাদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের ঢুকছে সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে। এগুলো শক্ত হাতে দমন না করলে আমার মতো আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতারা টিকে থাকতে পারবে না।

রাজশাহী জেলার সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, দ্বন্দ্ব আছে, তবে দ্বন্দ্বের কথা নয় আমি বলবো ঐক্যের কথা। দ্বন্ধ থাকতেই পারে তবে নিরসনের উপায় বের করতে হবে।

বরিশাল বিভাগের সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা বরিশাল বিভাগে ঐক্যবদ্ধ। তবে কোথাও কোন বিভেদ থাকলে, ভুল বোঝাবেঝি থাকলে মীমাংসা হবে না কেন?

টাঙ্গাইল জেলার সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা যাব না। এক ও অভিন্ন থেকে এগিয়ে যাই। কেউ ভিন্ন চিন্তায় বিভক্ত হব না।

ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি জহিরুল হক খোকা বলেন, আওয়ামী লীগের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে খোন্দকার মোশতাক ঢুকে গেছে। নেত্রী আপনি বার বার এসব মাফ করে দেন। ফলে অপরাধীরা সাহস সঞ্চয় করে। আর মাফ করবেন না। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দেখেছি অশুভ প্রতিযোগিতা। তিনি বলেন, আমাদের একদল আপনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছি, আরেক দল আপনাকে পেছনের দিকে টানছে। খোকা বলেন, আমাদের ভেতরে বেশিরভাগ বিরোধ আদর্শের নয়, ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বের। এসব বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে জাতীয়ভাবে কাজ কর্মই শুধু জনগণ বিবেচনা করবে না, বিবেচনা করবে স্থানীয় ভাবে এমপিরা কি করছেন, সেই প্রশ্ন আসবে? সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরুদ্দিন কামরান বলেন, আমাদের সিলেট বিভাগে মোট ১৯টি আসন। সেখানে যারা বিজয়ী হয়েছেন তাদেরকে বিজয়ী করতে তৃণমূলের প্রত্যেক নেতাকর্মীর ঘাম ঝড়েছে। কিন্তু, বিজয়ী হয়ে সেসব এমপিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের ফারাক তৈরি হয়েছে। এসময় আগামীতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনগুলো কমিটি দেওয়ার সময়ে আমাদের অন্তর্ভু’ক্ত করে কমিটি দেয় না। ঢাকা থেকে কমিটি দেয় আমরা জানি না, চিনি না। আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সংগঠন।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, আমাদের সরকারের টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে যে উন্নয়ন হয়েছে সে হিসাবে আমরা জাগরণ সৃষ্টি করতে পারিনি। এমপিদের সঙ্গে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সৃষ্ট দূরত্ব কাটিয়ে তুলতে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

দলীয় মুখপাত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্পোকসম্যানের কথায় আমরা যদি বিভ্রান্ত হই তাহলে দলের আরও ক্ষতি হবে।’ এই বিষয়টিও শেখ হাসিনাকে দেখতে বলেন তিনি। সহযোগী সবগুলো সংগঠনের অসহযোগিতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সহযোগী সংগঠনগুলো বিপরীতমুখী হলে আমরা যারা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করি তারা কিভাবে কাজ করবো?

তাদের বক্তব্য শোনার পর প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে নিজ জেলার নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নৌকা প্রতীক যাদের দেব তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে দলের পক্ষে কাজ করতে হবে। কেউ অন্য কাউকে সমর্থন দেবেন না।

তিনি বলেন, সংগঠনকে গতিশীল করতে সব জেলার নেতাকে বছর শেষে সাংগঠনিক রিপোর্ট দিতে হবে।