দিনদিন বেড়েই চলেছে রাজধানীর জলাবদ্ধতা
দিনদিন বেড়েই চলেছে রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা। বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর জলাবদ্ধতার পরিমাণ বেড়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় হাঁটুপানি। এই জলাবদ্ধতাকে পুঁজি করে কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করেছেন খোদ নগর পরিকল্পনাবিদরা।
মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সালে সংস্থাটিকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করলেও ঢাকা ওয়াসা তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত।ওয়াসার এই ব্যর্থতার দায় যাচ্ছে সিটি করপোরেশনের ওপরে। আর জলাবদ্ধতার চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসাকে চরম ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন শুধু বড় বড় প্রকল্পের দিকে ঝুঁকছে। মেয়র হিসেবে জনগণ এর দায়ভার আমাকেই দিচ্ছে।
এর আগে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে একটি চিঠি দেন। এতে তিনি জানান, জলাবদ্ধতার দায় ওয়াসা নেবে না। কারণ, পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হলেও ওয়াসার চেয়ে সিটি করপোরেশনের পাইপলাইনের সংখ্যা বেশি। বার্ষিক ক্লিনিংয়ের ব্যাপারেও দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। এজন্য সামান্য বৃষ্টিতেই জলজট দেখা দেয়।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন সময়ে কথা উঠেছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা যে কোনও একটি সংস্থার কাছে থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন’ ব্যবস্থা দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরে একমত পোষণ করা যায়। প্রয়োজনে ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ সার্কেলের সব কাজ ডিসিসির কাছে হস্তান্তর করবে। এর আলোকে ওয়াসা ইক্যুপমেন্ট ও লজিস্টিক সাপোর্টের পাশাপাশি বিদ্যমান জনবল এক বছরের জন্য লিয়নে প্রেরণ করবে।’
এ অবস্থায় ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনও এ দায়িত্ব নিতে চায়, তবে এজন্য ঢাকা ওয়াসা তার জনবল ও সবড্রেন ঠিক করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশন শুধু এর ব্যবস্থাপনা করবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনেই জলাবদ্ধতা বেশি। দক্ষিণ সিটির জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকার মধ্যে শান্তিনগরে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর ফলে ওই এলাকায় ৬০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলেও এখন আর পানি জমে না।
তবে এই এলাকাটি ছাড়া অন্যান্য এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩১০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার এবং ২৩৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এমন তথ্য জানিয়েছেন সংস্থার মেয়র সাঈদ খোকন। এর পরেও সংস্থাটির খিলগাঁও, শাজাহানপুর, সবুজবাগ, রাজারবাগ, ফকিরাপুল, আরামবাগ, যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা, জুরাইন, শহীদনগর,বাসাবো কালীমন্দির সড়ক, পুরনো ঢাকার নাজিরাবাজার, নাজিমউদ্দিন রোডে জলাবদ্ধতা দেখা যায়।
অপরদিকে নগর ভবনে দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার করেছে ডিএনসিসি। এছাড়া জরুরি মুহূর্তে নগরীর নর্দমা দ্রুত ও কার্যকরভাবে পরিষ্কার করার জন্য ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন কেনা হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জলাবদ্ধতার উন্নতি হবে।’ যদিও ডিএনসিসির এই যন্ত্রটি কেনার সময় বলা হয়েছে, মাত্র ১০ মিনিটেই এই যন্ত্রটি বিশাল এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে সক্ষম হবে।’
ডিএনসিসির অভিজাত এলাকা বসুন্ধরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, পূর্ব রামপুরা, হাজীপাড়া, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, প্রগতি সরণীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বাড্ডা, কারওয়ান বাজার, বেগুনবাড়ি, পান্থপথের বিভিন্ন এলাকা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মালিবাগের গুলবাগ, মগবাজারের নয়াটোলা সড়ক, ফার্মগেটের পূর্ব ও পশ্চিম রাজাবাজার, খিলক্ষেত নিকুঞ্জ ও নিকুঞ্জ-২ এর জামতলা এলাকা, উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর, মিরপুরের শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, কালশী ও মধুবাগে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
এদিকে জলাবদ্ধতা থেকে দ্রুত মুক্তি দিতে দুই সিটি করপোরেশন তার কাউন্সিলর ও পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকদের সমন্বয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে কমিটি গঠন করে দিয়েছে। ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ নামে ওই কমিটিতে ১০ জরে সদস্য রয়েছে। সে হিসেবে দুই সিটির ৯১টি ওয়ার্ডে ৯১০ জন কর্মী থাকার কথা। বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা হলেই এসব কর্মীরা মাঠে নেমে ড্রেন ও ম্যানহেলগুলোর ঢাকনা খুলে দেবে। একই সঙ্গে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নিতে হলে তাও করবে। কিন্তু জলাবদ্ধতা হলে এসব কর্মীর কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা বেড়েছে। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। পুকুর, জলাশয় এবং উন্মুক্ত স্থান না থাকায় বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভে যেতে না পারা। অন্য দিকে খাল দখল ও পর্যাপ্ত ড্রেন না থাকায় বৃষ্টির পানি নদীতে যেতে পারে না।এ কারণেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘পানি ওপর থেকে পড়বে, এটা বিশেষ রহমত। কিন্তু আমরা এই পানিকে দুর্ভোগের কারণ করে ফেলেছি। আমাদের উন্নয়ন সড়কের নামে পানির এই প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এজন্যই নগরবাসীকে প্রতিবছর দুর্ভোগে পড়তে হয়।’
এই স্থপতি আরও বলেন, ‘যে পদ্ধতিতে দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা এগোচ্ছে তাতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামী বছরগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকার দুই মেয়র ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একাধিক বার ফোন করা হলেও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে দক্ষিণ সিটির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আমাদের বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে। শান্তিনগরের জলাবদ্ধতা থেকে আমরা মুক্তি পেতে শুরু করেছি। তাছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে মেয়র সাঈদ খোকন প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন করে দিয়েছেন। এই টিমে ১০ জন করে সদস্য রয়েছেন। বৃষ্টি বা জলাদ্ধতা দেখা দিলে এই টিম মাঠে থাকে।প্রতিবেদন বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন