দিনে ৩০০ রোহিঙ্গা ফেরত নিতে চায় মিয়ানমার

রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত নেয়া নিয়ে গড়িমসি শুরু করেছে মিয়ানমার। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার গতি কমাতে দিনে মাত্র ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায় দেশটি। তবে বাংলাদেশ মনে করে, দিনে কমপক্ষে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো প্রয়োজন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের এমন টালবাহানার মধ্যে আগামীকাল সোমবার দেশটির প্রশাসনিক রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দল শনিবার ইয়াঙ্গুন পৌঁছেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলমানদের বড় অংশ এরই মধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক বছর ধরেই প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় পালিয়ে আশ্রয় নিয়ে আছেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে কথিত ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’ (আরসা) নামের একটি অখ্যাত গ্রুপ জঙ্গি হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে মিয়ানমার। এ হামলায় মিয়ানমারের নয়জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছেন বলেও দাবি করে দেশটি। তার জের হিসেবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই অভিযানে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, বাড়িঘরে আগুন, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা। ওই সময়ে প্রাণভয়ে প্রায় ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। তারপর অভিযান বন্ধ হলে রোহিঙ্গাদের আসার ঢল সাময়িকভাবে থামলেও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ফের মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলার ঘটনার কথা বলা হয়। ওই হামলায় মিয়ানমারের ১১ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে মিয়ানমার দাবি করে। তারপর নতুন করে রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার। আগস্টের পর নতুন করে আরও প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়ে আছে।
সম্প্রতি চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ার্স’ (এমএসএফ) এক সমীক্ষায় জানায়, রাখাইন রাজ্যে গত বছরের আগস্টে শুরু হওয়া সেনা অভিযানে প্রথম মাসেই কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বলছে, সেখানে রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণ করা হয়েছে। জাতিগত নিধন ও গণহত্যার কথাও বলেছেন কেউ কেউ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকমহলের চাপের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। এ লক্ষ্যে দু’মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর অঙ্গীকার করে গত ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে দু’দেশের মধ্যে অ্যারেঞ্জমেন্ট সই হয়। তার আলোকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে দু’দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবদের নেতৃত্বে প্রত্যেক দেশের ১৫ জন করে মোট ৩০ সদস্যবিশিষ্ট যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে। যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের কার্যপরিধিও সই হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে এখন দু’দেশের মধ্যে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি নিয়ে কাজ চলছে। যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে চুক্তিটি সই হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। ফলে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হবে। তবে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তির নানা দিক নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র জানায়।
যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে যোগ দিতে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল শনিবার ইয়াঙ্গুনে পৌঁছেছে। ব্যক্তিগত কারণে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের একজন সদস্য মিয়ানমার যেতে পারেননি। বৈঠকে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির স্থায়ী সচিব মিন্ট থো। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা শনিবার বলেছেন, ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তির খসড়া মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করার পর মিয়ানমার তার ওপর কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এই চুক্তিতে মূলত প্রকৃত প্রত্যাবাসনের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের বিশদ থাকবে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারে কতগুলো রিসিপশন সেন্টার থাকবে, কীভাবে রোহিঙ্গা ফিরে যাবে, মিয়ানমারে তারা কীভাবে থাকবে এসবই উল্লেখ থাকবে। এসব চূড়ান্ত করে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকেই চুক্তিটি সই করার চেষ্টা থাকবে। তবে বড় ধরনের মতপার্থক্য থাকলে এবার চুক্তিটি সই না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রত্যাবাসন শুরুর নির্ধারিত সময়সীমা রক্ষা করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।’
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার গতি ধীর করতে চায়। তারা প্রতিদিন প্রায় তিনশ’ রোহিঙ্গা ফেরত নিতে চায়। এটা বাংলাদেশের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করার সময়সীমা ২০ বছরে ঠেলে দিতে চায়। এ রকম হলে অর্ধেক রোহিঙ্গা এমনিতেই বাংলাদেশে থেকে যাবে- এমন লক্ষ্য থেকে মিয়ানমার দুরভিসন্ধি করছে বলে ওই কর্মকর্তার অভিমত।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ অতীতে প্রতিদিন দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে পেরেছে। এবার রোহিঙ্গা এসেছে অনেক বেশি। ফলে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এটা না হলে দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।’
এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি লী সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিয়ানমার তাকে ওই দেশ সফর করার অনুমতি দেয়নি। ফলে লী বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ১৮ জানুয়ারি পাঁচ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসবেন। এ সময় তিনি কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
সংশ্লিষ্ট অপর এক কর্মকর্তা শনিবার বলেছেন, রোহিঙ্গাদের আসার কারণে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে জিডিপি কমে যাবে। তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন করা জরুরি। কিন্তু মিয়ানমার এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। তার একটা হল, প্রতিদিন স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া। অপরদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে মিল রেখে আরসার হামলা এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিঘ্ন ঘটাবে বলেও মনে হয়। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় না। তারা নিয়মিত আরসা নাটক সাজিয়ে তিনশ’ রোহিঙ্গা নেবে আর পাঁচশ’ ফেরত পাঠাবে- এমন নাটক করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে চাইবে। ফলে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এবার রোহিঙ্গাদের কোনো তালিকা যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে মিয়ানমারের কাছে দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এটা নিশ্চিত নয়। কেননা এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন