দুই দশকে বেনাপোল স্থলবন্দরে ৯ বার অগ্নিকাণ্ডে তদন্ত কমিটি হয়, ক্ষতি পূরণ পায়নি কেউ
গত বছরের মত আবারো বেনাপোল স্থলবন্দরে আগুনে পুড়েছে আমদানি পণ্য বিচিং পাউডারবাহী ভারতীয় ট্রাক। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এনিয়ে গত দুই দশকে দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে বড় ধরনের ৯টি অগ্নিকান্ডে ঘটনা ঘটলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে টনক নড়েনি বন্দর কর্তৃপক্ষের। অগ্নি নির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও জনবল না থাকায় বার বার অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়ে পথে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, বেনাপোল স্থলবন্দরে বিচিং পাউডারবাহী ভারতীয় ট্রাকে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামি এক সপ্তাহের মধ্যে এ কমিটি অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ জানাবেন। বেনাপোল বন্দরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসানকে প্রধান করে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এর আগে ৭ জুন সন্ধ্যা ৭ টায় বন্দরের ৩৫ নম্বর পণ্যগারের সামনে ঢাকা-কোলকাতা মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এ ট্রাককে আগুন ধরে মালামালসহ ট্রাকটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। পরে এক ঘণ্টা চেষ্টা করে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, বন্দরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের জনবল বাড়ানোর বিষয়ে এর আগেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিপূরণ পান তার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে বন্দরের ১০ নম্বরসহ ১০টি পণ্যগারে আগুনে পুড়ে ক্ষতি হয় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য, ২০০১ সালে ২৬ নম্বর পণ্যগারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয় ৩০ কোটি, ২০০৫ সালে ১০ ও ৩৫ নম্বর পণ্যগারে আগুনে ক্ষতি হয় ৭০ কোটি, ২০০৯ সালের পহেলা জানুয়ারিতে ৩৫ নম্বর পণ্যগারে আগুনে ক্ষতি হয় প্রায় ৫০০ কোটি, একই বছরের ২২ জুন ২৭ নম্বর পণ্যগারে আগুনে ক্ষতি হয় ১৫০ কোটি, ২০১৬ সালে ২ অক্টোবরে ২৩ নম্বর পণ্যগারে আগুনে পুড়ে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা, ২০১৮ সালের ৬ জুন বন্দরের ২৫ নম্বর শেডে আগুন ধরে এক ট্রাকের পণ্য নষ্ট হয়। ভারতীয় ট্রাক টার্মিনালে এ আগুনের ঘটনায় প্রায় ১০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায়। ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে অগ্নিকাÊ প্রায় ৫০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায় এবং সর্বশেষ গত ৭ জুন বেনাপোল বন্দরের ৩৫ নম্বর পণ্যগারের সামনে মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় বিচিং পাউডারবাহী ট্রাকে আগুন লেগে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের। এছাড়া ছোটখাটো আরও ৫ থেকে ৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এ সময়ে।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক জানান, বেনাপোল বন্দরে আমদানি পণ্যের ধারণ ক্ষমতা ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু সেখানে সব সময় আমদানি পণ্য থাকে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। বন্দরে জায়গা সংকটে অনেক সময় সাধারণ পণ্যগারে কেমিক্যাল পণ্য রাখা হয়। এতেই আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। আর যখন আগুন ধরে তখন বন্দরের পর্যাপ্ত জনবল ও সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় নেভানোর আগেই সব পুড়ে শেষ হয়ে যায়।
তিনি আরো জানান, তিন বছর আগে বেনাপোল বন্দরের ২৩ নম্বর পণ্য গুদামে তার আমদানিকৃত প্রায় ২৫ লাখ টাকা মূল্যের পণ্য আগেুনে পুড়ে ছাই হয়। এতে এক প্রকার তার পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ক্ষতিপূরণের আবেদন করলেও এখনও কিছু পাননি তিনি।
বর্তমানে এখানে আমদানি পণ্য রক্ষাণাবেক্ষণে ৪৪টি পণ্যগার, ৪টি ওপেন ইয়ার্ড, একটি রফতানি টার্মিনাল ও একটি ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল ও একটি আমদানিকৃত গাড়ির চ্যাচিস রাখার টার্মিনাল রয়েছে। যেখানে ১৬৩ জন আনসার সদস্য, বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী পিমার ১০৩ জন ও এপিবিএন নামে একটি নিরাপত্তা সংস্থার ২০ সদস্য আমদানি পণ্যের রক্ষাণাবেক্ষণে ও নিরাপত্তায় কাজ করছে। তবে এসব চাহিদার তুলনায় অনেকাংশে কম।
স্থানীয় আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পণ্যগারে জায়গার অভাবে খোলা আকাশের নিচে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রাখা হচ্ছে মূল্যবান আমদানি পণ্য। এতে প্রায় চুরি হচ্ছে পণ্য। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের আগে বন্দরের পণ্যগার থেকে চুরি বেড়ে যায়। আর যখন চুরির পরিমাণ বেড়ে যায় তখন বাঁচতে বন্দরের স্টোর কিপাররা ইচ্ছা করেই পণ্য গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে প্রচার করে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট আগুন লেগেছে। ধামা চাপা পড়ে যায় চুরির ঘটনা। গত দুই দশকে এনিয়ে ৯ বার বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে কয়েকশ আমদানিকারক। বিভিন্ন আইনি জটিলতায় টাকা না পেয়ে ব্যবসা বন্ধ হয়েছে অনেকের।
আমদানিকারক চেীধুরী এন্টার প্রাইজের মালিক বিলাল চৌধুরী জানান, বছর ৭ আগে বেনাপোল বন্দরের পণ্য গুদামে রহস্যজনক অগ্নিকান্ড তার ১৫ লাখ টাকার আমদানি পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তিনি ক্ষতিপূরণের আবেদন করলেও আজ পর্যন্ত কোনো টাকা পায়নি। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষ আগুনের কারণও তাকে জানায়নি। ওই ঘটনার পর থেকে পুঁজি হারিয়ে আর তিনি ব্যবসা করতে পারেননি।
বেনাপোল পৌর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা রতন কুমার দেবনাথ জানান, বন্দরে আগুন লাগলে তারা সাহায্যে এগিয়ে যায়। তবে খবর পেতে দেরি হলে তাদের কিছু করার থাকেনা। গত ৭ জুলায় বন্দরে ভারতীয় ট্রাকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তারা লোক মুখে খবর পান। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়নি। আগুন নেভানোর আগেই ট্রাক ও মালামাল পুড়ে শেষ হয়ে যায়। খবর যদি আগে পেতাম হয়তো কিছুটা ক্ষতি কম হতো।
বেনাপোল বন্দরের ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান জানান, এত বড় স্থলবন্দরে মাত্র ৪ জন জনবল নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটলে আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়। বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ হয়নি। বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে যশোর, মণিরামপুর ও ভারতের পেট্টাপোল বন্দরের ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতা নিয়ে বন্দরের আগুন নেভাতে হয়।
যশোর চেম্বার অব-কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, বেনাপোল বন্দরে বারবার আগুন লাগলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আগুনে অনেক ব্যবসায়ী নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কোনো ক্ষতিপূরণ তারা পায়না।
বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার জানান, বন্দরে ফায়ার সার্ভিস অফিসে প্রয়োজনীয় জনবল বাড়ানোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আগে বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে নিদিষ্ট পণ্যগারে পণ্য নামানোর ক্ষেত্রে কিছুটা অনিয়ম হতো। তবে এখন নিয়ম মেনেই স্টোর কিপাররা পণ্য নামিয়ে থাকেন। বন্দরে পণ্য চুরি একেবারে নেই বললে চলে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যেন ক্ষতিপূরণ পায় তার জন্য চেষ্টা করা হয়। তবে নানান প্রতিবন্ধকতায় ক্ষতিপূরণ পাওয়া জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ ভারতীয় ট্রাকে আগুনের ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। আপাতত ধারণা করা হচ্ছে বিচিং পাউডারে পানি পড়ে তেজক্রিয়া হয়ে আগুন ধরেছে। তবে তদন্ত শেষে অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণও ক্ষতির পরিমাণ জানানো হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন