দুই দেশের অস্ত্রের মাঝে চলছে ৬০০০ রোহিঙ্গার জীবনযাপন
নিঃশ্বাসের ওপর ভর করে আছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু পয়েন্টের নোম্যান্সল্যান্ডে বসবাসরত ছয় হাজারের অধিক রোহিঙ্গার জীবন। সীমান্তের দুই দেশের অস্ত্রের মাঝেই চলছে তাদের নিত্যদিনের জীবনযাপন। কখন কার জীবনের রঙিন বাতি নিভে যায় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি চরমভাবে আতংক বিরাজ করছে সীমান্ত এলাকার স্থানীয়দের মাঝেও।
শুক্রবার দুপুরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু এলাকায় দেখা হয় ৫৬ বছর বয়সী আবুল হোসেনের সঙ্গে। পুলিশ, বিজিবি ও প্রশাসনের গাড়ি দেখে সামনে এগিয়ে আসেন তিনি। বলেন, বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। দুই মেয়ে (বিয়ে হয়ে গেছে) তিন ছেলের সংসারে স্ত্রী-নাতিসহ রয়েছে ১১ জন সদস্য। গত তিন দিন ধরে রাতে সীমান্ত এলাকায় বার্মার সেনাবাহিনীর গুলির কারণে যুদ্ধের ভয়ে কক্সবাজার জেলার রামুর আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছে তারা। আমি আছি গরু-ছাগল ও বাড়ি দেখাশোনার জন্য।
আবুল হোসেনের মতোই বৃহস্পতিবার সারা রাত থেমে থেমে ফাঁকা গুলিবর্ষণের ঘটনায় আতঙ্কে রাত পার করেছে বলে জানান জিরো পয়েন্টে অবস্থানরত রোহিঙ্গা কামাল উদ্দিন ও রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ।
দিল মোহাম্মদ বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার পর থেকে শুক্রবার ভোর সকাল পর্যন্ত সীমান্তের মিয়ানমার অংশে কয়েক দফায় ফাঁকা গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। এছাড়া তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়ার প্রত্যেকটি খুঁটির সঙ্গে সিঁড়ি (মই) দিয়ে রেখেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ সিঁড়ি বেয়ে তারা যে কোনো মুহূর্তে জিরো পয়েন্টে প্রবেশ করতে পারে। মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছেন। যে কোনো মুহূর্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গার ওপর গুলিবর্ষণ করতে পারে।
তুমব্রু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মুখোমুখি অবস্থায় যে যার মতো নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মুখোমুখি এই অবস্থানের মধ্যে অসহায় হয়ে পড়েছে নোম্যানসল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা।
সূত্রমতে, গত বছর ২৪ আগস্টে একটি মিথ্যা অভিযোগ তুলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনারা হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন চালায়। এতে সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে এ পর্যন্ত প্রায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। আর দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী জিরো পয়েন্টে অস্থায়ী তাঁবু করে বাস করছে এক হাজার পরিবারের প্রায় ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সদস্য।
মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট এলাকার চেয়ারম্যান এশার আলম বলেন, শুক্রবার সকালে সাতটি বড় গাড়ি ও তিনটি ছোট গাড়িতে করে প্রায় ২০০ জন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি জিরো পয়েন্টে টহল দেয়া শুরু করে। এরপর পালা পরিবর্তন করে তারা টহল অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে বর্তমান থমথমে পরিস্থিতিতে শুক্রবার তুমব্রু সীমান্তে দুই দেশের পতাকা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে তিনটি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা লাগিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। শুক্রবার এই সিসি ক্যামেরাগুলো লাগানো হয়।
বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজখবর নিয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, মিয়ানমার তাদের সীমানায় সেনাসংখ্যা বাড়াচ্ছে। রোহিঙ্গারা রয়েছে জিরো পয়েন্টে। আর গোলাগুলি ও সেনা টহল সব সীমান্তের ওপারেই হচ্ছে। সীমান্তের আমাদের অংশে কোনো সমস্যা নেই। তারপরও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) শূন্যরেখা ক্রস করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি উল্লেখ করে বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তারা (মিয়ানমার) বাড়তি সেনা মোতায়েন করেছে।
শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে দুই পক্ষের পতাকা বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত ভালো কিছু হবে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, শূন্যরেখা ক্রস করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর যদি ঘটে তাহলে আমরা তা প্রতিহত করব। তাদের সীমানার ভেতরে কি হচ্ছে বা তারা কী করবে সেটা তাদের বিষয়।
কক্সবাজার বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবদুল খালেক সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্ত এলাকায় বিজিবির কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। শুক্রবার দুপক্ষের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা রাখছি দ্রুত সময়ে সব কিছুর সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করবে।
এদিকে শুক্রবার সকালে তুমব্রু সীমান্তের ‘নোম্যান্সল্যান্ড’ এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলিপ কুমার বণিক, ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান, বান্দরবান লামা উপজেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুস সালাম, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এন সরয়ার কামালসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন