দুটি বন্দর ব্যবহার করবে ভারত, বাংলাদেশ কী পাবে?
চট্টগ্রাম ও মংলা এই দুটি বন্দর ব্যবহার করতে পারবে ভারত৷ ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পরিবহণ সহজ ও সাশ্রয়ী হবে৷ প্রশ্ন উঠেছে– এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে?
বাংলাদেশকেও কলকাতা এবং হলদিয়া বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে৷
বৃহস্পতিবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে দ্বীপ ও উপকূলবর্তী এলাকায় নৌ পরিবহন বাড়াতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি সই হয়েছে৷ এসব চুক্তিতে সই করেন বাংলাদেশের নৌ পরিবহন সচিব আবদুস সামাদ ও ভারতের জাহাজ মন্ত্রণালয়ের সচিব গোপাল কৃষ্ণ৷
নদী ও সমুদ্র যোগাযোগবৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রোটোকল অনুযায়ী, ১২তম স্ট্যান্ডিং কমিটির দুই দিনের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে মোট তিনটি চুক্তি এবং আরো কিছু বিষয়ে ঐক্যমতের কথা জানানো হয়৷ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড’-এর (পিআইডাবলিউটিটি) এই বৈঠক হলো দুই বছর পর৷
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহ করতে দুই দেশ চুক্তি করেছে৷ এছাড়া দুই দেশের মধ্যে নদী সংযোগ বাড়িয়ে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য অভিন্ন নদীর সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে৷ কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে আসামের গুয়াহাটি ও জোরহাটের মধ্যে নদীপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছে৷ ভারতের চেন্নাই থেকে জাহাজে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার পর্যন্ত পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে৷
বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতকে কত খরচ দিতে হবে? সেই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের নৌ পরিবহন সচিব আবদুস সামাদ সাংবাদিকদের বলেন, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) ঠিক করার সময় এসব চূড়ান্ত হবে৷’’
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত সমঝোতাপত্র (এমওইউ) সই হয়৷ এরপর গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ চুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দেয়৷ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, পণ্য সামগ্রী পরিবহণে শুধু বাংলাদেশের নৌ-যান ব্যবহার করা যাবে৷
আরো যত প্রটোকল:
বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের গেঁওখালি ও কোলাঘাটের মধ্যে রূপনারায়ণ নদীকে এবার প্রটোকল রুটের মধ্যে আনা হবে৷ আর সে কারণে পশ্চিমবঙ্গের কোলাঘাট ও বাংলাদেশের চিলমারীকে নদীবন্দরে উন্নত করা হবে৷ এই নদী পথে পণ্য পরিবহন চালু হলে খুব সহজেই বাংলাদেশ ফ্লাই-অ্যাশ ও অন্যান্য সিমেন্ট নির্মাণ সামগ্রী কম খরচে আনতে পারবে৷
এছাড়া আসামের বদরপুরে এবং বাংলাদেশের আশুগঞ্জের পাশে ঘোড়াশালে নদীবন্দর তৈরি করা হবে৷ কলকাতা থেকে আসামের শিলচর পর্যন্ত প্রটোকল রুটের আওতায় এনে পণ্য পরিবহন ও ক্রুজ চলাচলের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে এই বৈঠকে প্রস্তাব দেয়া হয়৷ কলকাতা থেকে ঢাকা, গুয়াহাটি হয়ে জোরহাট পর্যন্ত রিভারক্রুজ চালানোর সিদ্ধান্ত হয়৷
প্রটোকল অ্যান্ড ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের আওতায় ভারতের ধুবড়ি ও বাংলাদেশের পানগাঁওকে নতুন বন্দর হিসেবে ব্যবহার করার চুক্তি সই হয়েছে৷ প্রটোকল রুটের সম্প্রসারণের ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো সরাসরি কলকাতা, হলদিয়া ও বাংলদেশের মংলা বন্দরকে ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে৷ এতে অবকাঠামোগত ব্যয় তুলনামূলকভাবে কমবে৷
দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান থেকে বাংলাদেশের রাজশাহী হয়ে আরিচা বন্দর পর্যন্ত প্রটোকল রুট চালুর বিষয়ে প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা খতিয়ে দেখবে৷ ভাগীরথী নদীতে জঙ্গিপুরে নেভিগেশন লক পুনর্গঠনের বিষয়টি ফারাক্কা দিয়ে গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি অনুসারে খতিয়ে দেখবে৷ এই প্রটোকল রুট চালু হলে আসামের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জলপথে দূরত্ব ৪৫০ কিলোমিটার কমে যাবে৷
ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটের আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ-ডাউকি জলপথের উন্নয়নে ৮০ শতাংশ আর্থিক সহায়তা করবে ভারত৷ এই জলপথে ড্রেজিংয়ের জন্য যৌথ কমিটি গঠিত হয়েছে৷ দু’টি দেশই আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের জন্য যোগীগোপাকে শিপিং টার্মিনাল হিসাবে উন্নয়নের জন্য একমত৷ মুন্সীগঞ্জ নৌ টার্মিনালে বাংলাদেশ শুল্ক দফতরের পরীক্ষা করা পণ্য কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন করা যাবে৷
বৃহস্পতিবার বৈঠকের পর আবদুস সামাদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি যত ঘটবে, ততই দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে৷ সম্পর্ক উন্নত হবে৷ ঘনিষ্ঠতা বাড়বে৷ তিনি জানান, এই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ৷ অথচ সম্ভাবনা প্রচুর৷’’ ভারতের জাহাজ পরিবহন সচিব গোপাল কৃষ্ণ বলেন, ‘‘খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বিশ্বাস ও ভরসার আঁধারে এই আলোচনা হয়েছে৷ দুই দেশের লক্ষ্য অভিন্ন, পারস্পরিক উন্নয়ন৷’’
বর্তমানে প্রটোকল নৌরুটে ৩৫ লাখ টন পণ্য পরিবহণহয়৷ প্রটোকল রুট বৃদ্ধি এবং নতুন বন্দর ব্যবহারের চুক্তির পর এর পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে৷
ব্যবসায়ী অর্থনীতিবিদদের অভিমত:
বাংলাদেশ ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)-এর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে আমাদের ট্রানজিট আগেই হয়ে গেছে৷ এখন সুনির্দিষ্টভাবে প্রটোকলগুলো সই হচ্ছে৷ ভারত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করবে৷ আমরাও কলকাতা ও হলদিয়া বন্দর ব্যবহার করতে পরব৷ এতে উভয় দেশের পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে৷ পরিবহন সহজতর হবে৷ আমরা ভারত থেকে অনেব বেশি আমদানি করি৷ আমাদের আমদানি খরচও কমবে৷ মূল কথা কানেকটিভিটি বাড়বে৷ আমরা বদ্ধ ঘরে থাকতে চাই না৷ শুধু ভারত কেন? বিমসটেকের মাধ্যমে আমরা ভুটান ও থাইল্যান্ডের সঙ্গেও যুক্ত হতে চাই৷ তবে আমাদের সড়কগুলো আরো প্রশস্ত করতে হবে৷ বন্দরগুলোর ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘পণ্য পরিবহণের সঙ্গে যাত্রী পরিবহণের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নৌপথে এটা অনেক কাজে দেবে৷ পর্যটকরা নৌপথে ভ্রমণ করতে পারবেন৷’’
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তীতুমীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য কম করে৷ বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বেশি করে৷ এর পিছনে নানা ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা এবং কারিগরি ও কৌশলগত বাধার কারণে আমদানি ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়৷ ফলে আমরা বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি দেখতে পাই৷ এর পিছনে রাজনৈতিক এবং বাস্তবায়নগত সমস্যা কাজ করে৷ ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বাড়ছে না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ট্রান্সশিপমেন্টসহ নানা নামে বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারত কিন্তু বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহণের সুবিধা আগে থেকেই পেয়ে আসছে৷ এখন বন্দর সুবিধাও পাবে৷ কিন্তু এটা দৃশ্যমান হতে হবে যে এর মাধ্যমে বাংলাদেশও উপকৃত হচ্ছে৷ সেটা কিন্তু এখনো দৃশ্যমান নয়৷’’
তিনি বন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশ যে হ্যান্ডেলিং ও ট্রানজিট চার্জ পাবে সেই প্রশ্নে বলেন, ‘‘এই সব চার্জ বড় কথা নয়৷ বড় কথা হলো বাংলাদেশ যেন আমাসির নেটওয়ার্ক না হয়৷ বাংলাদেশ যদি কাঁচামাল এনে উৎপাদনের মাধ্যমে রপ্তানির নেটওয়ার্ক হতে পারে, তাহলেই বাংলাদেশের লাভ৷’’
-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন