দুনিয়ার ‘নরক’ সিরিয়া, অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে মায়েরা
সিরিয়া, মৃত্যু উপত্যকা বললেও মাত্র কিছুটা বোঝানো হয়। জাতিসংঘের ভাষায়, দুনিয়ার ‘নরক’। কাক কখনো কাকের মাংস খাই না- প্রবাদটির বিপরীত চিত্র দেশটিতে। শাসকদের ভোরই হচ্ছে, নিজ নাগরিকদের রক্তপানে। শুধু তাই নয়, পরাশক্তিদের ডেকে এনে পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তের হোলিতে মত্ত হয়েছে সিরিয়ানরা। দিন, মাস কিংবা বছরে নয়, প্রতি সেকেন্ডেই বুক খালি হচ্ছে কোনো না কোনো মায়ের।
আলেপ্পো শেষ, এখন পালা দামেস্কের। মরুজমিনের চেহারা পাল্টে হয়েছে বিরাণভূমি। মাঠের পর মাঠ যতদূর চোখ যায় শুধুই ধ্বংসস্তূপ।
২০১৩ সাল থেকেই চলছে যুদ্ধ। কোনো সাম্রাজ্য দখলের নয়, এই যুদ্ধ রীতিমত নিজ ভাই-বোন ও সন্তান হত্যার। বিগত ৮ দিনেই রাজধানী দামেস্কের পূর্ব ঘৌতায় ৫৬০ জনের প্রাণ গেছে। এই সংখ্যা বাড়ছেই। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরেও হামলা অব্যাহত রয়েছে।
মূলত পূর্ব ঘৌতাকে আসাদ বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ধরা হয়। সিরিয়ান সেনাবাহিনী ৪ লাখ বসতির ওই অঞ্চলে স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে রাশিয়ার সহায়তায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। এতেই ২০১৩ সালে কেমিক্যাল বোমা হামলায় দেড় শতাধিক নিহতের পর এত বড় প্রাণহানি হলো।
পূর্ব ঘৌতার অধিবাসীরা বোমা থেকে বাঁচতে সুড়ঙ্গ তৈরি করে বসবাস করছেন। অবশ্য ২০১৫ সাল থেকেই তাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে আসাদ বাহিনী। খাদ্য, বস্ত্রের মতো ন্যূনতম মৌলিক অধিকার পর্যন্ত তারা পায়নি। সম্প্রতি সেখানে ত্রাণ প্রবেশও আটকে দেয়া হচ্ছে।
এর ফলে এই প্রাণঘাতী হামলার আপাতত কোনো শেষ দেখছেন না বিশ্লেষকরা। বিদ্রোহীরা যতটা পারছে আসাদ বাহিনীর মোকাবেলা করছে। কিন্তু, এটাই কি পূর্ব ঘৌতাকে নিরাপদ রাখতে যথেষ্ট? এক কথায় না, পরিস্থিতি এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকার পর্যায়ে।
তাইতো সর্বশেষ হামলার পর পূর্ব ঘৌতার নারীদের অস্ত্র হাতে নিতে দেখা গেছে। তারা বিদ্রোহীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমেছেন।
পূর্ব ঘৌতার যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দুই সাংবাদিকের কণ্ঠেও এমনটি এসেছে। আল জাজিরাকে তারা বলেছেন, পূর্ব ঘৌতার বর্তমান পরিস্থিতিকে ২০১৩ সালের কেমিক্যাল বোমা হামলা পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলেও কম বলা হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি স্থানীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে যা দেখা গেছে, এক কথায় পূর্ব ঘৌতা একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।
সিরিয়ান অ্যাক্টিভিস্ট হাদি আল-আব্দুল্লাহ তার ফেসবুকে ছবি দিয়ে লেখেন, ‘ঠিক কতগুলো মর্টার হামলা হয়েছে, তার পরিসংখ্যান দেয়া কঠিন। তবে শুধুমাত্র দু’দিনেই ২০০ মর্টার ফেলা হয়েছে।’
আলজাজিরাকে সাংবাদিকরা একটি ঘটনার বর্ণনা দেন এমন, বোমার পর আগুনে ঝলসে গেছেন এক মা। তার শরীরের ঝলসানো চামড়াগুলো কেটে কেটে ফেলা হচ্ছে।
একটি ১০ বছর বয়সী বাচ্চার বুকের ওপর ব্যারেল চাপানো। হয়ত তার অপরাধ সে সিরিয়ায় জন্মেছে এবং মুসলিম।
এক নারীর একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে ধরে আছেন। তার সামনেই অস্ত্র হাতে আরেক নারী, যিনি সর্বশেষ বিমান হামলায় প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হারিয়েছেন।
ভিডিওতে এক নারী বলছেন, পূর্ব ঘৌতার মানুষকে আল্লাহ লড়াইয়ের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে সব সময় প্রস্তুত। এ নিয়ে ভীত নই। কারণ, আমরা একমাত্র আল্লাহর কাছেই জবাবদিহি করব এবং শেষ বিচারে পুরস্কৃত হব।
তিনি বলে চলেন, আস-শামস জাতিদের কখনো বশীভূত করা যাবে না। আমরা আমাদের লক্ষ্যে অটুট। যে জিহাদে আছি, তা চলবে।
একই সঙ্গে তিনি তাদের এই লড়াইয়ে মুসলিম উম্মাহ এবং মুসলিম সেনাবাহিনীকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
এরই মধ্যে আরেক নারী চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমরা মুহাম্মদের (সা.) কন্যা। নিপীড়িত মুসলিম নারী। কোথায় মুসলিম উম্মাহ এবং আমাদের মুসলিম সৈনিক ভাইয়েরা?’
পূর্ব ঘৌতার ঐতিহাসিক এবং কৌশলগত অবস্থান পবিত্র কোরআনেই বর্ণিত আছে। মূলত এটি বিগত কয়েক বছর ধরে আসাদ বিদ্রোহীদের খাবার সরবরাহের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখান থেকেই বিদ্রোহীরা দামেস্ক বিমানবন্দরে হামলার পরিকল্পনা করেছিল।
পূর্ব ঘৌতার মানুষেরা ঐতিহাসিকভাবেই সাহসী চিত্তের। তারা কখনো মুখ বুজে অন্যায়কে সহ্য করেন না। আসাদের অন্যায়কেও প্রশ্রয় দেননি। আর এই কারণেই আসাদের আক্রোশের শিকার তারা। পূর্ব ঘৌতাবাসীকে সরকারি বাহিনী নৃশংসভাবে নির্মূলের চেষ্টা করছে। যেমনটি কয়েক বছর আগে রাশিয়ান বাহিনী তাদের চেচেন প্রজাতন্ত্রের রাজধানী গোজনীতে করেছিল।
২৪ বছর বয়সী আনাদুলু এজেন্সির ফটো সাংবাদিক আম্মার আল-বুশি। এই প্রতিষ্ঠানের আগে তিনি ২০১৩ সালে সিরিয়ায় রয়টার্সের সাংবাদিক ছিলেন।
আম্মার জানান, সাংবাদিকতার পাশাপাশি এখন তিনি সিরিয়ার পূর্ব ঘুটায় ভলান্টিয়ারের কাজ করেন, ‘আমি জানি এখানে সাংবাদিকতা কত কঠিন! সবাই এদের লক্ষ্য করে হামলা করে।’
তিনি জানান, চোখের সামনে এত এত বিভৎস মৃত্যু দেখেছি, যা কোনো ভাষাতেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
আম্মারের ভাষায়, আমরা তো কতভাবেই কত কি ফুটিয়ে তুলি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি। কাউকে ভালোবাসি কিংবা শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু, পূর্ব ঘৌতাবাসী প্রাণের বিনিময়ে তাদের রক্তের রঙে যে চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তুলেছেন, তা দেখে আমরা সত্যিই অবাক!
তিনি বলেন, পূর্ব ঘৌতার হামলাকে ২০১৩ সালের আগস্টে কেমিক্যাল অস্ত্রের হামলার সঙ্গেই কেবল তুলনা করা যায়। ফুলের মত শত শত বাচ্চা কিভাবে মরছে, বিশ্বাস করানো যাবে না পৃথিবীতে চোখকে এর চেয়ে কঠিন আর কিছু মনে হয় দেখানো সম্ভব নয়! এরপরও আমরা তাদের ছবি তুলছি। ওই যে বললাম আমি সাংবাদিক, এজন্যই হয়ত পারছি।
তাহলে এর শেষ কোথায়- এমন প্রশ্নে আম্মারের বক্তব্য, গোটা বিশ্বই হয়ত এখানকার মানুষের দুর্ভোগ বুঝবে না। কিন্তু, এখানে এটাই সত্য, কেউ অন্যায় মেনে নেবে না। শেষ পর্যন্ত কেউই চুপচাপ মরতে পছন্দ করবে না।
২৭ বছর বয়সী দামেস্কের মিডিয়া সেন্টারের এডিটর আলা আল-আহমাদ জানান, দামেস্কের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সাংবাদিকতায় পড়ালেখা করেছেন। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয়ের আগে পূর্ব ঘুটার মানুষ বলতে ভালবাসেন।
আল-আহমাদ জানান, তিনি ২০১৩ সালের মধ্য আগস্টে কেমিক্যাল অস্ত্রের হামলার সাক্ষী ছিলেন। গত সপ্তাহে পূর্ব ঘৌতায় এমন হামলা শুরু হয় যে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শরণার্থী শিবিরের বেসমেন্টে থাকতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, এখানে খাবারের সংকট, পানি নেই। ত্রাণসহায়তাও আসতে দেয়া হচ্ছে না। মানুষ কতটা কষ্টে আছেন, তা বলে বোঝানো যাবে না।
মূলত সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গি দমনের অজুহাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো হামলা চালাচ্ছে। তারা আসাদ বিদ্রোহীদের সাহায্য করছে। বিপরীতে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বাহিনীকে সহায়তা করছে রাশিয়া, ইরান ও ক্ষেত্র বিশেষে তুরস্ক।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন