দূরপাল্লার বাস চালান কারা, কেমন তাদের মানসিকতা?
ঢাকার রাস্তায় বা দূরপাল্লার রুটে বাস যারা চালান, তারা কারা? কতটুকু তাদের প্রশিক্ষণ, কি তাদের মানসিকতা? তাদের অবস্থান থেকে বাস চালানোর অভিজ্ঞতা. ঝুঁকি, সুবিধা-অসুবিধাগুলোই বা কেমন?
একটা ধারণা পেতে সকাল নয়টায় গেলাম আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকায় অন্তত আটটি রুটে ৩০টিরও বেশি বাস চলাচল করে।
অফিস এবং স্কুল কলেজের সময়, তাই সবারই তাড়া, সবাই চান বাসে একটি কাঙ্ক্ষিত আসন পেতে, না পেলে দাঁড়িয়েই যেতে হবে। বাসের চালক এবং সহকারী – প্রচলিত ভাষায় যাদের হেল্পার বলা হয় – তারা সমানে চেষ্টা করছে গাড়ীতে যত বেশি পারা যায় তত যাত্রী ওঠানোর।
আমি একটি বাসে উঠলাম। গন্তব্য মিরপুর ১৪ নম্বর – যেখানে বাসগুলো সব যেয়ে থামে এবং সেখানে আছে ঢাকার আরেকটি বড় বাসস্ট্যান্ড।
মিরপুর ১৪ নম্বর পৌঁছাতে লেগে গেল দু’ ঘণ্টার বেশি সময় । বাস থামার পর দেখলাম ছাড়ার অপেক্ষায় আছে আরো কিছু বাস, যাদের চালকরা বসে আছেন।
তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউ কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না।
‘অনেক সময় ভুল হইয়া যায়, মাথা ঠিক থাকে না’
অবশেষে একজন চালক আমার সাথে কথা বলতে রাজি হলেন। গত ১২ বছর ধরে তিনি এই ঢাকা শহরে বিভিন্ন রুটে বাস চালাচ্ছেন।
“রাস্তার অবস্থাতো ভয়ংকর খারাপ, রাস্তা ভাঙা, তার পর আছে যানজট” – শুরুতেই তার কথা।
প্রশ্ন করলাম, এসব কারণেই কি অ্যাকসিডেন্ট হয়?
“অনেক সময় অন্য গাড়ী চাপায়া দেয়, অনেক সময় ভুল হইয়া যায় গা” – স্বীকার করলেন তিনি
কী ধরণের ভুল হয়? জানতে চাইলাম।
“একদিকে গাড়ী আসলে আরেকদিক চাপায় দেয়, আবার আরেকদিক দিয়ে গাড়ী চলে, মাথা ঠিক থাকে না ।”
চালকদের আরো নানা সমস্যার কথা বললেন তিনি।
“অনেক জন আছে, সিগনাল মানে না। নতুন আইছে ঢাকা শহরে, বেতাল হয়ে চলে।”
জানতে চাইলাম, “সিগনাল মানে না বলছেন, কিন্তু তারা কি বাস চালানো শিখে আসে না?”
তিনি বললেন, “প্যাসেঞ্জারের চাপ থাকে, প্যাসেঞ্জার বলে এমনে যা, অমনে যা।”
প্যাসেঞ্জার কেন বলবে? সব গাড়ীর একটা নির্দিষ্ট রুট তো আছে – জানতে চাই।
তার জবাব – “প্যাসেঞ্জারের সাথে ঝামেলা হয়। মারধর করে। আবার অনেক রকম ডিস্টার্ব আছে। ওস্তাদের কাছ খেকে শিখে আসে। কোন ভদ্রতা জানে না, রাস্তার নিয়ম কানুন অনেক সময় জানে না।”
এই চালকের সাথে কথা বলতে বলতেই তার গাড়ী যাত্রীতে ভরে গেল। আর কথা বাড়ানোর সুযোগ থাকলো না।
বাসচালকদের মনে কাজ করে ‘যত বেশি সম্ভব ট্রিপ মারার’ চাপ
বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে গড়ে প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, কিন্তু কিছু ঘটনা থেকে রীতিমত চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় মিলছে।
সব ছাপিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে: যে চালকরা রাস্তায় নানা ধরণের পরিবহন-যান চালাচ্ছেন তাদের মনোজাগতিক অবস্থা নিয়ে।
বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট বলছে, “বাস চালকরা ট্রিপ ভিত্তিক গাড়ী চালায়। অর্থাৎ যত বেশি ট্রিপ তত বেশি টাকা। এটা তাদের ওপর মানসিক একটা চাপ তৈরি করে।”
“কারণ, দিন শেষে ঐসব মালিকদের সাথে চুক্তিমত নির্দিষ্ট অংকের টাকা তাকে বুঝিয়ে দিতেই হয়। সেক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসেবটা আসে পরে।”
শুধু রাজধানী ঢাকা শহরে ৩০০ রুটে যানবাহন চলাচল করছে। এসব গণ-পরিবহনের সংখ্যা ৫ হাজার, তার মালিকের সংখ্যা ৪ হাজার। এসব মালিকদের মধ্যে আবার ভাগ রয়েছে।
বিশ্রামহীনতা, ক্লান্তি, চাপ, মানসিক অসুস্থতা
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের শিক্ষক কাজী মো.সাইফুন নেওয়াজ বলছিলেন, দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন একজন বাসচালকের ওপর কতটা চাপ থাকে।
একজন চালকের মানসিক অবস্থাকে এভাবে বিশ্লেষণ করছিলেন তিনি। বলছিলেন- “গাড়ীতে ওঠার আগে দেখা যায় তার পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেই, ১৪/১৫ ঘণ্টা একটানা গাড়ী চালিয়েছে সে আগের দিন। আবার মালিক বলে দিচ্ছে ‘জমার’ এত টাকা দিতে হবে।”
“অর্থাৎ, গাড়ী স্টার্ট করার আগেই সে একটা প্রেশারের মধ্যে পড়ে যায়। এরপর একটানা গাড়ী চালানোর ফলে তারমধ্যে ‘ফেটিগ’ বা ক্লান্তি চলে আসে, ফলে তারমধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই দেখা দেয় মানসিক অসুস্থতা ।”
চালকদের মাদকাসক্তি বড় রকমের সমস্যা
ঢাকার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড। এখানে একটি মুদি দোকান চালান মো. সোলাইমান। প্রায় ১৫ বছর বাস চালিয়েছেন।
কিন্তু এখন তিনি আর চালকের বসতে চাননা। কারণ কী?
তিনি বলছিলেন “দেখেন, এরা সকাল বেলা ‘নেশা করে’ গাড়ী চালানো শুরু করে। কোন নিয়ম-কানুন জানে না, শুধু প্রতিযোগিতা। কাউকে ছাড় দেবে না, ভদ্রতা নেই। কেউ যদি ইমার্জেন্সি লাইট দেয় তাহলেও তাকে সাইড দেয় না।”
“এরা হেল্পার থেকে ড্রাইভার হচ্ছে। বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে টাকা দিয়ে। ওদের মনমানসিকতাই নেই কারণ ওরা যে পরিবেশে থাকে সব ড্রাইভার, হেলপারদের সাথে।”
“আমি এখন এই সেক্টর থেকে চলে আইছি, কারণ আমি পারি না আর এসব সহ্য করতে” – বললেন তিনি।
গত মে মাসে ঢাকায় পরিবহন মালিকদের সংগঠন বলেছিল, ঢাকা শহরের পরিবহন শ্রমিকদের প্রায় ৫০% মাদক সেবন করে।
এর মধ্যে বেশির ভাগই আবার ইয়াবা খাচ্ছে। এই তথ্যের সাথে একমত হয়েছে অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটও। এটাও তাদের মানসিক বিকাশে চরম বাধাগ্রস্ত করছে বলে তারা জানাচ্ছে।
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট বলছে, “যখন রাস্তায় গাড়ী কোন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে আসে – তখন নেশার কারণে কয়েক মুহূর্তের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকে না এসব চালকদের। এর পরিণতি অবধারিত দুর্ঘটনা।”
‘পাবলিকেরও একটু সতর্ক থাকতে হবে’
আমি কথা বলেছি দুইজন চালকের সাথে যারা প্রাইভেট কার চালান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা তাদের সমস্যগুলোর কথা বলছিলেন।
“আমি ড্রাইভিং করতেছি, জ্যামের মধ্যে আছি আমার মালিক বলছে ‘এই তুই এখনো আসিস নাই কেন। তুই কই।’ তখন আমি একটা মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যাই। কাউকে কেউ সাহায্য করবে তা এই মন-মানসিকতায় নেই”।
আরেকজন ড্রাইভার বলছিলেন – “প্রত্যেকটা সিগন্যাল ছেড়ে দিলেই দেখা যায়, মানুষ এলোপাথাড়ি দৌড় দিচ্ছে, এটা কিন্তু উচিত না। কারণ সিগনাল ছাড়ার পর একটা গাড়ী টান দিলেই ২০/৩০ মাইল গতি উঠে যায়। ঐ মুহূর্তে যদি ব্রেক করি, তাহলে কিন্তু ম্যানেজ করা যায় না। তখন অন্য গাড়ী বা পথচারীর সাথে লেগে যাচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাচ্ছে।”
“আমার মনে হয় পাবলিকেরও একটু সতর্ক থাকতে হবে।”
যারা ব্যক্তিগত গাড়ী, সিএনজিসহ অন্য যানবাহন চালান তারা কেন রাস্তায় পাল্লা দিয়ে চালান এবং দুর্ঘটনা ঘটে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলছেন, চালকদের মানসিক বিকাশে আর্থ-সামাজিক অবস্থা একটা বড় কারণ।
তিনি বলছিলেন, “এটা যে একটা সম্মানজনক পেশা – সেটাই আমরা আমাদের দেশে সামাজিক ভাবে তৈরি করতে পারিনি। তার অধিকার, তার জীবনবোধ, তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হলেই কিন্তু একজন ব্যক্তির পেশাগত জীবনে সুস্থতা তৈরি করে। কিন্তু এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি একজন পরিবহন শ্রমিক বা যেকোন পেশার মানুষের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা এবং অস্বাভাবিকতা তৈরি করতে পারে। ”
“একজন পরিবহন শ্রমিক- সব সময় সে তটস্থ থাকে তার সামাজিক পরিচয় নিয়ে, হীনমন্যতায় থাকে তার আর্থিক অনিশ্চয়তা নিয়ে। এই যদি হয় তার সামাজিক এবং মনজাগতিক অবস্থা, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক কারণ সে সব সময় একটা অস্থিরতার মধ্যে থাকে।”
‘ওস্তাদের কাছে শেখা’
বাংলাদেশ গণ-পরিবহণের চালক হিসেবে প্রশিক্ষণের প্রচলিত ব্যবস্থা হল ‘ওস্তাদের’ কাছ থেকে শেখা।
অর্থাৎ ড্রাইভারের কাছ থেকে হেল্পাররা শেখে এবং এক সময় বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালায়।
সেখানে একজন চালক হিসেবে তার শারীরিক সুস্থতা এবং যে গুটিকয়েক বিষয় দেখা হয় – যেটা মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
তারা মনে করছেন, এক্ষেত্রে একজন চালক মানসিক ভাবে স্বাভাবিক কিনা, রাস্তার গাড়ী চালানোর সাধারণ নিয়ম-কানুন বা সহনশীলতা এবং অন্যের জরুরি প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রবণতা সম্পর্কে আদৌ কোন জ্ঞান আছে কিনা – সেটা পরীক্ষা করা হয় না।
আমি এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ এর রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক শেখ মো. মাহবুবে রাব্বানীর কাছে।
তিনি স্বীকার করলেন এত খুঁটিনাটি বিষয় দেখার মত ক্যাপাসিটি তাদের নেই। তবে তারা সাধ্যমত চেষ্টা করছেন।
তিনি বলছিলেন “যারা এই পেশায় আসছে তাদের রুটটা ভালো না। তাদের পড়াশোনা নেই আবার থাকে বস্তিতে। তাই তাদের কাছ থেকে সেই আচরণ আশা করা যায় না। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় তাদের মানসিক বিকাশ সম্ভব না। তবে আমরা এখন জেলা পর্যায়ে শক্তিশালী কমিটি করে দিয়েছি। তাদের সুপারিশ নিয়ে আমরা লাইসেন্স দেয়। তবে তাদের মানসিক বিকাশের এইসব দিক গুলো খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ আমাদের নেই”।
বিআরটিএ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যারা বলছে বিদেশে যে প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স দেয়া হয় বাংলাদেশে সেটা হয় না।
আর এদেশে ড্রাইভিং পেশাটাকে সম্মানজনক করা যায় নি সামাজিক কারণে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুযায়ী সারা দেশে গত জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় তিন হাজার ২৬ জন মানুষ নিহত হয়েছে।
আবার শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বলছে, ২০১৭ সালে পরিবহন খাতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা গেছে, যার সংখ্যা ৩০৭ জন।
চালকদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে যাত্রীদের ভাবনা কি?
আজিমপুর থেকে মিরপুরগামী সেই বাসে কথা বলেছিলাম একজন নারী যাত্রীর সাথে।
তিনি বলছিলেন, “তারাতো এভাবে নিজেদের ইচ্ছামত চালাতে পারে না। আমি আমার মত করে চালাবো, অন্যদের আমার দেখার বিষয় না – এই মেন্টালিটিটা চেঞ্জ করতে হবে, তাহলে রাস্তায় একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এসব কাজে একজন দায়িত্বশীল মানুষকে রাখা উচিত, এমন কোন র্যান্ডম মানুষকে রাখা উচিত না যারা কেয়ারলেস।”
তাহলে কি তারা ঝুঁকি নিয়েই উঠছেন এসব গণ-পরিবহনে?
“কোন উপায় নেই। আমার কাজে যেতে হয় প্রতিদিন” – বললেন তিনি, “এখন সিএনজি বা অন্য পরিবহনের যে খরচ সেটা আমি দিতে পারবো না। ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বাধ্য হয়ে এসব চালকের পরিবহনের উঠতে বাধ্য হচ্ছি রোজই।”
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন