দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে নায়করাজ রাজ্জাকের দশটি চরম সাহসী মন্তব্য!

আলাউদ্দিন আদর : আজ (২১ আগস্ট) সন্ধ্যায় এক বিনোদন সংবাদকর্মী বন্ধু ফোন করে বললো-আদর ভাই,নায়ক রাজ্জাক আর নেই 😢! খবরটা শোনার পর থেকে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।বারবার নায়ক রাজের চেহারা ও সংলাপ হৃদয়পটে ভাসছিল।দেশের এই দুর্দিনে দেশ এমন একজন দেশপ্রেমিক অভিবাবক হারালো যে,যার শূন্যস্হান কোন ভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়।প্রিয় নায়ককে নিয়ে কি লিখবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না।পরে চিন্তা করলাম,বাংলা চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে উনার শেষ জীবনের প্রত্যাশা গুলো সবার সামনে সার সংক্ষেপরূপে তুলে ধরি ।সরকার এবং চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলেই আন্তরিক হয়ে এই বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দিলে তা আমাদের ফিল্মইন্ডাষ্টির সামগ্রিক উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।দেশের উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু গনমাধ্যমে বিক্ষিপ্ত ভাবে প্রকাশিত নায়ক রাজ রাজ্জাকের দশটি মন্তব্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

এক.
-চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরার চেষ্টা করতে হবে। এর আগেও চলচ্চিত্র নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। উর্দু ছবি যখন চলছিল তখন ভালো বাংলা ছবি দিয়েই চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরাতে হয়েছে। তখন জান বাজি রেখে কাজ করেছি আমি। শুধু আমি না পরিচালক জহির রায়হান, কাজী জহির, মোস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, মিতাসহ চলচ্চিত্রের অনেকে যার যার জায়গা থেকে ভালো কিছুর জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তখন চলচ্চিত্র একটা পরিবার ছিল। তখন আমরা যারা কাজ করতাম আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল। একে অপরকে সম্মান করতাম। টাকার পেছনে দৌড়াতে হয়নি আমাদের।

দুই.
-বাংলা ছবির মতো বাংলা ছবি চালালে অবশ্যই চলবে। ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’ ছবিগুলো তো দর্শক ঠিকই দেখেছে। আমার কথা হচ্ছে যেটা আমাকে খাওয়াবে তুমি, সেটা ভালো করে খাওয়াও। তুমি শুঁটকি মাছ খাওয়ালে সঠিকভাবে রান্না করে খাওয়াতে হবে। এলোপাতাড়ি রান্না করলে তো হবে না।

তিন

-এখন ৩ জন আর্টিস্ট নিয়ে ৫ দিন পূবাইলে শুটিং করলো, এরপর বাকি সবকিছু দেশের বাইরের শিল্পী ও কলাকুশলী নিয়ে করে ফেলছে, এটা তো হতে পারে না। যৌথ প্রযোজনার নামে এখন যেসব সিনেমা হচ্ছে সেগুলোতে কি আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো নির্মাতার নাম দেখেছেন?

চার.
-একজন শিল্পী হিসেবে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমার আক্ষেপ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থার জন্য। এই শিল্প দাঁড় করানোর কোনো উপায় দেখছি না আর।

পাঁচ.
-মনের দুঃখে এখন আর এফডিসিতে যেতে ইচ্ছে করে না। দুঃস্থ শিল্পীদের দিকে তাকানো যায় না। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আমার সময়ে ৩০০ সিনেমা হল থেকে ১২০০ সিনেমা হল হয়েছে। আর এখন দিনের পর দিন সিনেমা হল কমছে।

ছয়.
-ববিতা, কবরী, সুচন্দা কেউই তো এখন আর কাজ করছে না। এখন তো অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় আইটেম গানের নামে মেয়েরা নাচছে।

সাত.
-আমাদের সময়ে নায়িকারা শাড়ি আর হিরোরা পাঞ্জাবি পরে দর্শকদের সিনেমা হলে বন্দি করে রেখেছিল।

আট.
-আগে প্রযোজকরা ছবি বানানোর পর যে টাকা লাভ করেছে তা দিয়ে আরো ভালো কিছু ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছে। শিল্পীরাও যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট থেকে ভালো ভালো কাজ করেছে। তখন আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল যে, চলচ্চিত্র শিল্পটাকে ভালো একটা অবস্থানে নেয়া। এখন যারা আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে আছি তাদের অনেকের কথা ভেবে আমার দুঃখ লাগে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। আমি যখন টপ হিরো তখন চেষ্টা করেছি বাংলা ছবিকে শীর্ষে নিয়ে যেতে। এখন শিল্পীসত্তা বিষয়টি নেই। আগে আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, খলিলসহ যেসব সিনিয়র অভিনেতা কাজ করতেন তাদের দোয়া নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এখন অভিনয়শিল্পীরা শুধু গ্ল্যামার আর টাকা খুঁজছে। আর অন্য কোনো চিন্তা করছে না। এভাবে তো কোনো ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না।

নয়.
-চলচ্চিত্র শিল্প বাঁচাতে যৌথ কিংবা ভারতীয় সিনেমার দরকার নেই। যৌথ প্রযোজনার সিনেমা হতে হলে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। কিন্তু এখন তো রীতিমতো স্মাগলিং হচ্ছে। অন্যদের সিনেমা আমাদের এখানে চালানো হচ্ছে।’

দশ.
-ভারতের সাথে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নিয়ে সমালোচনা করে এই অভিনেতা বলেছিলেন-‘যৌথ প্রযোজনা তো এভাবে হয় না, যেভাবে এখন হচ্ছে। আপনারা জোড়ালো আন্দোলন শুরু করুন। আমি আপনাদের সাথে আছি। প্রয়োজনে মার খেতে রাজি আছি।’

নায়করাজ রাজ্জাক আজ আজ সন্ধ্যায় (২০১৭ সালের ২১শে আগস্ট সন্ধ্যা ৬:১৩ মিনিটে )হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপতালে মৃত্যুবরণ করেন।একই সাথে মৃত্যু হয় বাংলা চলচ্চিত্রের সৌনালি যুগের এক বর্ণিল ইতিহাসের।শোকে শোকাহত সিনেমাপ্রেমি কোটি কোটি মানুষ।শোকাহত কোটি হৃদয়ের প্রত্যাশা-নায়ক রাজ বেঁচে থাকবেন তার কর্মে।ওপারে ভালো থাকুক প্রিয় বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন সম্রাট…

অভিনেতা রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের (বর্তমান ভারত) কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বরসতি পূজা চলাকালীন মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য তার শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহী’তে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নায়করাজের অভিনয় জীবন শুরু। ১৯৬৪ সালে রাজ্জাক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ‘তের নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর ‘কার বউ’, ডাক বাবুতেও অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’। সে থেকে তিনি তিন শতাধিক বাংলা ও কয়েকটি উর্দু চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। পরিচালনা করেন ১৬টি চলচ্চিত্র।