দেশে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ
গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পার্টনারশিপ (জিএআরপি)-এর ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের হার বাড়ছে। যদিও প্রতিবেদনে কোনো পরিমাণগত তথ্য দেওয়া হয়নি।
কিন্তু বলা হয়, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট (এএমআর) ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নকল বা খারাপ মানের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের ব্যবহার, দুর্বল পরীক্ষাগারের ক্ষমতা এবং অপর্যাপ্ত ওষুধ পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি।
জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় বিশেষায়িত হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে।
চিকিৎসকরা বলছেন, রোগী যে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে, তা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত প্রায় এক শতাব্দী ধরে ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধী বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ জীবাণুকে নিয়ন্ত্রণ এবং ধ্বংস করতে সহায়তা করে আসছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার এবং অপব্যবহারের কারণে কিছু ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএতে ছোট পরিবর্তন (মিউটেশন) ঘটে এমন ‘সুপারবাগ’ তৈরি হচ্ছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং উন্নত বিশ্বের গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করেছেন, নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) অ্যান্টিবায়োটিকের উচ্চ ব্যবহারের ফলে ‘সুপারবাগ’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ সেখানে রোগীরা সবচেয়ে বেশি অসুস্থ থাকায় শক্তিশালী ওষুধগুলোকে রুটিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ফলে জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে উঠছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) সূত্রে জানা গেছে, গত মাসে ভর্তি হওয়া তিন মাস বয়সী শিশু আরিশার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে রাখা হয় নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ)। তাকে সুস্থ করে তুলতে দেহে উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়। তাতে তার শারীরিক অবস্থা আরো অবনতি হতে থাকে। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে আরিশাকে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে নেওয়া হয়। এই হাসপাতালে দুই সপ্তাহ চিকিৎসা নেওয়ার পর মারা যায় শিশুটি।
আরিশার আকস্মিক এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করেছেন চিকিৎসকরা। নিউমোনিয়া থেকে শিশুটিকে সুরক্ষার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলেও সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি ওষুধ।
চিকিৎসকরা বলছেন, এমন ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে জীবাণুর মধ্যে। এটি এক নতুন মহামারি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
একারণে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ন্ত্রণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, টিকাদান, জীবাণুরোধী স্টুয়ার্ডশিপ, সরকারি ও বেসরকারি প্র্যাকটিশনারদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মানব ও পশুর শরীরের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান জানান, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ওভার দ্য কাউন্টার বিক্রি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ খাতে, বিশেষ করে হাঁস-মুরগি ও মৎস্য চাষে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সব হাসপাতালে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
তিনি বলেন, ৫০টিরও বেশি জেলায় জীবাণুরোধী সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ জন্য ডাক্তাররা তাদের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তুলনামূলকভাবে উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিক থেকে ওষুধ দিতে শুরু করেন, কিন্তু তাদের এটা করা উচিত নয়। এগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। তাদের অনেকেই উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতিনিধিদের চাপ দেয়।
সায়েদুর রহমান জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের (ডিএমআই) সর্বশেষ তথ্য ও বিশ্লেষণ নিশ্চিত করেছে যে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো বাংলাদেশেও নীরবে উদ্বেগের একটি বড় কারণ হয়ে উঠছে ‘সুপারবাগ’।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলে সাধারণ সর্দি-জ্বর, কাটাছেঁড়া থেকে বড় ইনফেকশন, সবকিছুই রূপ নিচ্ছে মারণব্যাধিতে, কাজ করছে না কোনো ওষুধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার বলছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আবু সালেহ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক কীভাবে ব্যবহার করা হবে, এ বিষয়ে দেশে তেমন কোনো আইন নেই।
এ নিয়ে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত চিকিৎসক ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না। তবে এটা তেমন নিয়ন্ত্রণে নেই।
তিনি জানান, মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো মনিটরিংও নেই। এটা যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন। দেশে প্রতিনিয়ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বাড়ছে। করোনা সংক্রমণের মধ্যে এই হার অনেক গুণ বেড়েছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এর ব্যবহার বাড়েছে। ফলে আগামীতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে আর একটি মহামারির অপেক্ষা করছে দেশ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন