দেশে ফিরলেন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বাংলাদেশি যুবক

দুই বছর আগে নিজের অজান্তেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়েন সিজোফ্রেনিয়ায় (জটিল মানসিক রোগ) আক্রান্ত বাংলাদেশি যুবক মামুন রশিদ (৩৭)। ভারতে প্রবেশ করা মাত্রই তাকে আটক করে স্থানীয় থানার হাতে তাকে তুলে দেয় বিএসএফ।

অবশেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজের বাংলাদেশে ফিরে এলেন রশিদ।

রবিবার নদীয়া জেলা প্রশাসন, বিএসএফ’এর কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গেদে সীমান্ত দিয়ে রশিদের বাবা মোহাম্মদ আবদুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হয় রশিদকে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নদীয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমিত গুপ্তা জানান, ‘রবিবারই রশিদ বাংলাদেশে তার বাড়ি ফিরে গেছে’।

২০১৫ সালের ১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চাপড়া থানার অধীন মহৎপুর গ্রাম থেকে বাংলাদেশি রশিদকে যখন বিএসএফ আটক করে, তখন তার পোশাক ছিল জীর্ণ, কথাবার্তাতেও ছিল অসংলগ্নতা; নিজের নাম-ঠিকানা ভালো করে বলতে পারছিলেন না তিনি।

আটকের সময় তার কাছে ছিল না ভারতে প্রবেশের বৈধ কোনো নথি। সে সময় অনুপ্রবেশকারী হিসাবে রশিদকে আটক করে বিএসএফ এবং পরে চাপড়া থানার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে তাকে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হলে, তাকে মানসিক অসুস্থ বলে জানায় চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকদের পরামর্শেই নদীয়া জেলা প্রশাসনের নির্দেশে রশিদকে পাঠানো হয় ‘নাকাশিপাড়া নির্মল হৃদয় সমিতি’ নামে একটি এনজিও’তে। সেখানেই চলে রশিদকে সুস্থ করে তোলার কাজ।

টানা চার মাস চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে রশিদ।
এনজিও’টির কর্মকর্তা মোসলেম মুন্সি জানান, ‘রশিদ মাঝে মধ্যেই সহিংস হয়ে উঠতো এবং আমার উপর হামলা করতো। এরপর একজন মনস্তত্ববিদকে ডেকে হোমের মধ্যেই তার চিকিৎসা শুরু করা হয়’।

তিনি আরও জানান, ‘আমি যেহেতু অন্য রোগীদেরও দেখতাম তাই রশিদের সেবাযত্নও আমি নিজেই করতাম। প্রতিদিন তাকে গোসল করাতাম, সেভিং করাতাম, কিছু শারীরিক ব্যায়ামও করাতাম। মাত্র চার মাসের মধ্যে রশিদ সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সে তার নাম ও ঠিকানা জানায়’।

ওই বাংলাদেশি যুবকের নাম ও ঠিকানা জানতে পেরেই বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বাসিন্দা রশিদের বাবা আবদুল করিমকে চিঠি লেখেন মোসলেম মুন্সি। চিঠি পেয়েই ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে নাকাশিপাড়া গলয়দাড়ি গ্রামে ওই হোমে গিয়ে মুন্সির সঙ্গে দেখা করেন রশিদের মামা নুরুল। রশিদের পরিচয়পত্র নিয়ে এসে তাকে শনাক্ত করেন মামা নুরুল।

এরপরই শুরু হয় রশিদকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। কিন্তু পরিচয়পত্রে রশিদের নামে কিছু ভুল থাকার কারণে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি সময় লেগে যায়।

রশিদের চিকিৎসক মনস্তত্ববিদ দেবাশিস দাসগুপ্ত জানান, ‘রশিদের সিজোফ্রেনিয়া’এর লক্ষণ ছিল। কিন্তু মামুন মুন্সির আপ্রাণ প্রচেষ্টা ও সেবাযত্নের ফলে খুব সহজেই রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে’।

এদিন ভারত-বাংলাদেশের গেদে সীমান্তে প্রায় দুই বছর পর বাবাকে দেখামাত্রই কান্নায় ভেঙে পড়েন রশিদ। পরম আদরে বাবাকে জড়িয়ে ধরেন তিনি।

নিজের দেশে ফিরে যেতে পেরে খুশি রশিদ। এনজিও’টির কর্মকর্তা মোসলেম মুন্সির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অবশেষে বাড়ি ফিরতে পেরে আমি খুব খুশি। আমি মোসলেম মামার কাছে কৃতজ্ঞ’। পাসপোর্ট ও ভিসা করে পরবর্তীতে ভারতে এসে মোসলেম মামার সঙ্গে দেখা করে যাবো।

রশিদের বাবা আবদুল করিম জানান, ‘রশিদের মা মারা যাওয়ার পরই মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পায় রশিদ। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ছেলের মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০১৪ সালে একদিন রাতে হঠাৎ করেই সে বাড়ি ছেলে চলে যায়। এরপর গত তিন বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় ছেলেকে খুঁজে বেড়িয়েছি। আমি যে আমার ছেলেকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো এই আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন ভারতের এনজিও’টির কর্মকর্তা মোসলেম মুন্সির কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েই আমার বুকে পানি আসলো। তিনি সত্যিই একটা ভালো কাজ করেছেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমার ছেলেকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন’।