নওগাঁয় শুরু হয়েছে অবৈধ ইটভাটায় অভিযান; ১৩৯টির মধ্যে ভাঙা হলো ৩টি

বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্টের এক আদেশে দেশব্যাপী অবৈধ ইটভাটা ভাঙার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনা মোতাবেক সারাদেশের ন্যায় নওগাঁতেও শুরু হয়েছে অবৈধ ইটভাটা গুড়িয়ে দেওয়ার অভিযান। তারি ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে জেলায় তিনটি ইটভাটা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে জেলার ১৩৯টি অবৈধ ইটভাটার মধ্যে দুই দিনে মাত্র তিনটি অবৈধ ইটভাটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সচেতনদের দাবি এই অভিযান যেন চলমান থাকে। এবং সকল অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই অভিযান চলমান থাকবে।

পর্যায়ক্রমে সকল উপজেলার সকল অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালানো হবে। গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) জেলার রাণীনগর উপজেলায় দুটি অবৈধ ইট ভাটা গুড়িয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এর আগে গত সোমবার ১০ মার্চ জেলার মান্দা উপজেলায় একটি অবৈধ ইট ভাটা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে করা হয়েছে নগদ অর্থদ্বন্ডও। তবে এই দুই উপজেলা দুই-একটি বৈধ ছাড়া আরও অনেক অবৈধ ইটভাটা আছে।

নওগাঁর স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানান, জনবসতি ও আবাদি জমির আশপাশে ইটভাটা স্থাপন করা নিষিদ্ধ হলেও জেলাজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অধিকাংশ ইটভাটার কোন বৈধ কাগজপত্রাদি নেই (অনাপত্তি ছাড়পত্র)। বছরের পর বছর সরকারের বিধিনিষেধকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অবৈধ ভাবে ইট উৎপাদন করে আসছে এই ইট ভাটাগুলো।

ফলে ভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে দিন যতই যাচ্ছে ততই পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে জীব-বৈচিত্র। বিগত সময়ে মাঝে মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র অবৈধ ইট ভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অর্থদন্ডই প্রদান করা হতো কিন্তু গুড়িয়ে দেওয়া হতো না।

নওগাঁ জেলা প্রশাসনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে অবৈধ ইটভাটা গুড়িয়ে দেওয়ার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। গত সোমবার জেলার মান্দা উপজেলার সতিহাটের নীলকুঠি এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে পরিবেশগত ছাড়পত্র ও ইট পোড়ানো লাইসেন্স ব্যতীত পরিচালনার দায়ে মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস নামক ইটভাটার চিমনী ও কিলন স্কাভেটর দিয়ে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়া হয়।

আর মঙ্গলবার জেলার রাণীনগর উপজেলাধীন কাশিমপুর ইউনিয়নের চকমনু ও চকাদিন গ্রামে লাইসেন্স ব্যতিত ইট ভাটা পরিচালনা, ইট প্রস্তুত ও বিক্রয় করার অপরাধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে মেসার্স রাহিদ এন্টারপ্রাইজ কে ২০ হাজার টাকা ও মেসার্স রিফাত ব্রিকস কে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং স্কাভেটর দিয়ে উভয় ইট ভাটার চুল্লি ভেঙ্গে দেওয়া হয়।

এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পানি দিয়ে ভাটার আগুন নিভিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাকিব বিন জামান প্রত্যয়। এছাড়াও মোবাইল কোর্টে প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পরিবেশ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোঃ নাজমুল হোসাইন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নওগাঁ জেলা আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের তিনটি চৌকস দল মোবাইল কোর্টে সহযোগিতা প্রদান করে। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট ইট ভাটা রয়েছে ১৬২টি। গত দুইদিনে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ৩টি। বর্তমানে সচল রয়েছে ১৫৯টি।

এর মধ্যে মাত্র ২৩টি ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে। বাকি ১৩৬টি ইটভাটার ছাড়পত্র নেই। ফলে তারা জেলা প্রশাসনের অনুমোদনও (লাইসেন্স) পায়নি।

এরপরও এসব ভাটায় থেমে নেই ইট পোড়ানো। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ ও ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভু‚মির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। কৃষিজমিতেও কোনো ইটভাটা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে না।

জেলায় এমন উপজেলা আছে যেখানে কোন ইটভাটার পরিবেশগত (অনাপত্তি) ছাড়পত্র নেই। এমনকি কোন কোন উপজেলাতে খড়ি দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ছাড়াই নিয়ম না মেনে কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ভাটার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এতে একদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন।

জেলায় আড়াই লাখ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি রয়েছে। সমতল ভু‚মি হওয়ায় বর্তমানে জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ জমিই তিন ফসলি। আইনের তোয়াক্কা না করে এসব ফসলি জমিতে ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়া বসতবাড়ির আশপাশেও ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসল ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন অবৈধ ইট ভাটা গুড়িয়ে দেওয়ার যে কার্যক্রম শুরু করেছে তা খুবই ভালো।

মাঝপথে এসে কার্যক্রম বন্ধ করে না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। গত দুই দিনে তিনটি অবৈধ ইটভাটা ভাঙার বিষয়টি এদিন বিকেল ৫টার দিকে মুঠোফোনে নিশ্চিত করেছেন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার মনিরুজ্জামান। জেলায় যতগুলো অবৈধ ইটভাটা আছে, সবগুলো ভাঙা হবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সবগুলো ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করার টার্গেট আছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা একদিনেতো এতোগুলো ইটভাটা ভাঙতে পারিনা। আজ মঙ্গলবার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে রাণীনগরে দুটা ও গত সোমবার মান্দায় একটা অবৈধ ইটভাটা ভাঙা হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্ট থেকে যেহেতু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কাজেই এখানে কোনো বাঁধা নেই। তাই পর্যায়ক্রমে জেলার সকল উপজেলার সকল ইটভাটা ভাঙা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাজমুল হোসাইনের মুঠোফোনে কল দিয়ে তাকে না পাওয়া তার বক্তব্য দেওয়া সমভাব হয়নি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল গণমাধ্যমকর্মীকে বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক সারা দেশের ন্যায় নওগাঁতেও অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হয়েছে। তারই ধাবারাহিকতায় অবৈধ ইট ভাটাগুলো গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের এমন কার্যক্রমকে কেউ বাধাগ্রস্থ করতে পারবে না। আমরা চেস্টা করছি আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাসের যোগ্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের।

পাশাপাশি একটি বাসযোগ্য নওগাঁ গড়ে তুলতে পুরো জেলাবাসীকে ভ‚মিকা রাখতে হবে। আগামীতেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ধরণের অভিযান অব্যাহত রাখা হবে বলেও জানান তিনি।