নতুন ব্যাংক আইনে নতুন জমিদারতন্ত্র?

বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এতোদিন একই পরিবারের দুইজনের থাকার সুযোগ ছিল। কিছু ক্ষেত্রে এর অনিয়ম হয়েছে। আবার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন কৌশলে তা বাড়িয়ে পরিচালকের পদ আগলে রেখেছেন কেউ কেউ। এরকম অবস্থায় একই পরিবারের দুইজনের পরিবর্তে চারজন ও পরিচালকদের মেয়াদ টানা ছয় বছরের পরিবর্তে নয় বছর করে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে।

দেশের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাতে এর প্রভাব কী হতে পারে?

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিতে রয়েছে। এরপরও অযৌক্তিকভাবে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে পরিবারতন্ত্র বাড়ার পাশাপাশি এ খাতে বাড়বে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। নতুন এই ‘জমিদারতন্ত্রের’ কারণে শৃঙ্খলাও ভেঙ্গে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন এই দেশে ধনী-গরীবের মধ্যে বেশি ব্যবধান থাকবে না। কিন্তু এই আইনের কারণে সেই ব্যবধান বাড়বে, বাড়বে বৈষম্যও।

‘এই আইন পাশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নীতিকে বিসর্জন দেয়া হলো, যা ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে নির্ঘাত দুঃসংবাদ বয়ে আনবে,’ বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর বলেন: অধিকাংশ ব্যাংকের চেয়ারম্যান থেকে পিয়ন কেউই এই আইনের সংশোধন চান না, কেবল কয়েকটি ব্যাংককে সুবিধা দিতে আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো আগামী নির্বাচনে হয়তো অর্থসহায়তা দেবে, তবে দেশের উদীয়মান অর্থনীতিতে এর পরিণাম হবে খুবই ভয়াবহ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে দেশের একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যানের তিন ছেলের বউ ও দুই ছেলেসহ মোট ৫ জন রয়েছেন। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আট দশমিক ০৫ শতাংশ।

অন্য একটি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে রয়েছেন এক পরিবারের পাঁচজন। শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক পদে আছেন তার স্ত্রী। নির্বাহী কমিটি (ইসি) ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান তাদের মেয়ে। এছাড়া পর্ষদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন দুই ছেলে।

এভাবে অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও একই পরিবারের তিন থেকে চারজন করে সদস্য রয়েছেন। কেউ কেউ কৌশলে মেয়াদ বাড়িয়ে বছরের পর বছর পরিচালকের পদে রয়েছেন।

এরকম অবস্থায় ‘পরিবারগুলোকে আরো সুযোগ দিতে’ আইনে সংশোধনী আনার বিষয়টিকে খুবই খারাপ কাজ হিসাবে অভিহিত করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন: এটা খুবই খারাপ কাজ হয়েছে। বিষয়টি সম্পূর্ণ অবিবেচনাপ্রসূত, রাজনৈতিক দূরদর্শীতাহীন এবং অর্থনীতিতে খুবই অযৌক্তিক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর দেওয়া মোট ঋণ সাত লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮০ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এই খেলাপি ঋণের সঙ্গে ঋণ অবলোপন করা ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মূলত ব্যাংক পরিচালকরা ভাগাভগি করে ঋণ নেয়ার কারণে খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

অর্থনীতির ভাষায়, সাধারণত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে পৌঁছলে তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, বর্তমানে খেলাপির পরিমাণ ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ আর বেসরকারি ব্যাংকে প্রায় ছয় শতাংশ। তবে বেসরকারি কোনো কোনো ব্যাংকে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ পর‌্যন্ত খেলাপি ঋণ রয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের সিনিয়র পর্যায়ের একজন অর্থনীতিবিদ নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন: সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন, ড. সালেহ উদ্দিন ও ড. ফখরুদ্দীন- এদের কেউ কেউ ব্যাংকিং খাতে সুশাসন দেখিয়ে গেছেন, কেউ সেই ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এ খাতটি বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে, কিন্তু ঝুঁকির কথা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করছে না।

তিনি বলেন: এই মূহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। আর ঠিক সেই মূহুর্তে এমন একটি সংশোধন ব্যাংকিং খাতে শুধু পরিবারতন্ত্র নয়, জমিদারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলামও মনে করছেন, আইনে সংশোধনী আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

তিনি বলেন: কেন আইন পাশ করা হলো সে বিষয়ে কোন যুক্তি উপস্থাপন করা হয়নি। ‍এমনিতেই ব্যাংকিং খাত খেলাপিতে জর্জরিত। সার্বিকভাবে অনেক ব্যাংকে সুশাসনের অভাব রয়েছে।

‘এখনও অনেক ব্যাংকে একই পরিবারের তিন-চার জন পরিচালক আছেন। আইন পাশের কারণে নতুন করে ব্যাংকগুলোতে পরিবারতন্ত্র আরো বেড়ে যাবে। ফলে ব্যাংকের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে, বাড়বে খেলাপির পরিমাণ। যার প্রভাব শুধু ব্যাংক খাতে নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে।’

বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আইএফসির বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের কান্ট্রি ম্যানেজার ওয়েন্ড ওয়ার্নার বলেন: যেহেতু আইন পাশ হয়ে গেছে, এখন উচিত হবে ব্যাংকের অভ্যন্তরীন সুশাসন নিশ্চিত করা।

‘এ খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এর কোন বিকল্প নেই।’

একই পরিবারের চারজন পরিচালনা পর্ষদে থাকা ও একটানা নয় বছর পরিচালক পদে থাকার বিধান রেখে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনী পাশ হয়েছে।

সংশোধনের আগের আইনে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুইজন সদস্য একটি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারতেন। আর তিন বছর করে পরপর দুই মেয়াদে মোট ছয় বছর পরিচালক থাকতে পারতেন একজন পরিচালক। এরপর তিন বছর বিরতি দিয়ে আবারও পরিচালক হতে পারতেন তিনি। সূত্র : চ্যানেল আই অনলাইন