নুসরাতকে পুড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিয়েছিল জাবেদ, পপি ও মনি
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডে ১৬ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে ৭২২ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) বুধবার আদালতে জমা দেয়া হবে।
মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা ও ফেনী আওয়ামী লীগের দুই নেতাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে বুধবারই আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হবে। এতে ১৬ জনের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে।
মাদ্রাসার অর্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং যৌন হয়রানির মতো নানা অপকর্মের সঙ্গে এই ১৬ জনই একে অপরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট বলেও জানান ডিআইজি বনজ। তিনি বলেন, নুসরাত তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় তারা প্রত্যেকে সুচিন্তিতভাবে সুস্থ মস্তিষ্কে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, চার্জশিটভুক্ত ১৬ জনের মধ্যে ১২ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন জাবেদ, পপি ও মনি।
এ সময় নুসরাত হত্যায় এই ১৬ আসামির কার কী ভূমিকা ছিল, তা প্রজেকশনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের কাছে স্পষ্ট করেন পিবিআই প্রধান।
নুসরাত হত্যায় কার কি ভূমিকা :
এসএম সিরাজউদ্দোলা- হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও এর চেয়ে বেশি করেছেন। তার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাতে কাজ না হলে নুসরাতকে ভয়-ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা দেন তিনি। কিভাবে হত্যা করতে হবে তারও নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনাও দেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।
নুর উদ্দিন- হত্যাকাণ্ডের আগে যে কক্ষে বোরখা রাখা ছিলো, সেটি পরিদর্শন করে আসেন তিনি। ঘটনার সময় ভবনের নিচের পরিস্থিতিটা খুব চাতুরতার সঙ্গে সামলে নেন। পুরোটা সময় নাটকের মতো চিত্রায়ন করতে সহায়তা করেন।
শাহাদাত হোসেন শামীম- হত্যাকাণ্ডের আগে পরিকল্পনার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শামীম। কিভাবে কে কী করবে তার পুরো পরিকল্পনা সাজান শামীম। তিনি কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেন। যে টাকা দিয়ে বোরখা ও কেরোসিন কেনা হয়। তার জবানবন্দি অনুযায়ী পরে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাস উদ্ধার করা হয়।
মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর- ২৮ মার্চ সিরাজের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন তিনি। শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে না থাকলে আইসিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার হুমকি দিতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন। হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি ১০ হাজার টাকা দেন। ঘটনার সবকিছু জানলেও ঘটনার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ফেনীতে অবস্থান করছিলেন তিনি।
সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের- তিনি ঘটনাস্থলে নুসরাতকে শোয়ানোর পর পা বেঁধে দেন। নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢালার পর শামীমের নির্দেশে নিজের সঙ্গে থাকা ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন- তিনি নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালেন। নুসরাতকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে খুবই ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে চলে যান। পরে চিৎকার শুনে ছুটে এসে নুসরাতকে দেখতে যান, এমনভাব করে যেন কিছু জানেন না।
হাফেজ আব্দুল কাদের- তিনি নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু। ঘটনার সময় মেইন গেটের বাইরে পাহাড়ায় ছিলেন। নুসরাত পরীক্ষার হলে ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না, ভাই নোমান দেখতে চাইলে কাদের তাকে বাধা দেন। কাদেরের কাছে নুসরাতের বিষয় জানতে চাইলে কাদের জানান, ২ মিনিট পর জানাচ্ছি। পরে তিনি জানান, নুসরাত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
আবছার উদ্দিন- ঘটনার সময় তিনি গেট পাহাড়ার দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও আগের মামলার বাদীকে ফোন করে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন।
কামরুন নাহার মনি- শামীম তাকে ২ হাজার টাকা দিয়ে বোরখা ম্যানেজ করতে বলেন। এ টাকায় ২টি বোরখা ও হাতমৌজা কেনেন। কেনা ২টি বোরখাসহ তার নিজের কাছ থেকে একটি মিলিয়ে মোট তিনটি বোরখা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় রেখে আসেন। ছাদে ওঠানোর পর নুসরাতকে শুইয়ে ফেলতে সহায়তা করেন এবং বুকের উপর চাপ দিয়ে ধরে রাখেন। ঘটনার পর ঠাণ্ডা মাথায় এসে তিনিও পরীক্ষায় অংশ নেন।
উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা- নুসরাতকে ছাদে ওঠানোর পর মামলা তুলে নিতে প্রথমে চাপ দেন তিনি। রাজি না হওয়ার নুসরাতের গায়ে ওড়নাটি বের করেন পপি। এরপর ওড়নাটি ২ ভাগ করে দেন, যা দিয়ে নুসরাতে হাত ও পা বাঁধা হয়। নুসরাতের হাত পেছন দিয়ে বাঁধার পর কেরোসিন ঢালার গ্লাসটি নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দেয়। যাতে বোঝা যায় নুসরাত আত্মহত্যা করেছে।
আব্দুর রহিম শরীফ- তিনি বাইরের গেটে পাহারায় ছিলেন। নুসরাতের ভাই ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেন তিনি।
ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন ও মহিউদ্দিন শাকিল- তারা গেটে পাহারায় ছিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক বুঝাতে যা যা করণীয় তা করছিলেন তারা।
মোহাম্মদ শামীম- তিনি প্রথমে পপির সঙ্গে ভবনটির গেটে পাহারায় ছিলেন। যাতে কেউ সে সময় ভবনে উঠতে না পারে এবং এর ফলে অন্য কাউকে খুন করতে না হয় সেজন্য সতর্ক ছিলেন তিনি।
রুহুল আমিন- ঘটনার পর মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে পুলিশ-প্রশাসন সবকিছু ম্যানেজ করার আশ্বাস দেন তিনি। হত্যাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করেন। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে দুই দফা ফোনে কথা বলে সবকিছু নিশ্চিত হন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন