ন্যাটোকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন ট্রাম্প?
পশ্চিমা সামরিক জো ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মিত্রদের সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আবারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জোটের অন্যতম সদস্য দেশ জার্মানির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, জার্মানিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়া। তিনি বলেন, গ্যাস চুক্তি করে জার্মানি রাশিয়াকে শত শত কোটি ডলার দিচ্ছে, অথচ ন্যাটোর সদস্য হিসেবে প্রতিরক্ষা খাতে জার্মানির যা খরচ করার কথা, তার অর্ধেকও তারা করে না।
যেভাবে ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রদের ফারাক বেড়েই চলেছে, তাতে এই প্রতিরক্ষা জোট কি আদৌ টিকবে? বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা জোনাথান মার্কাসের বিশ্লেষণ :
ন্যাটো জোট কিসের জন্য
মূলত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের যে কোন ধরনের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্যই গঠন করা হয়েছিল ন্যাটো। কিন্তু স্নায়ু যুদ্ধ যখন থেমে গেল, তখন ন্যাটো জোটের উদ্দেশ্যও কিছুটা বদলে যায়। ইউরোপে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হলো নতুন অনেক দেশকে। অন্য অনেক দেশের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা হলো।
এই পর্যায়ে ন্যাটো জোট কোন কোন দেশের যুদ্ধ-বিগ্রহ বা গণহত্যা থামাতে সরাসরি হস্তক্ষেপও করলো। যেমন বলকান যুদ্ধ।
তবে ন্যাটো জোটকে কেবলমাত্র একটি সামরিক প্রতিরক্ষা জোট ভাবলে ভুল করা হবে। এটি আসলে তার চেয়ে বেশি কিছু।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো বাকি বিশ্বকে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, ন্যাটো ছিল তার অন্যতম। আটলান্টিকের দু্ই তীরের দেশগুলোর অভিন্ন মূল্যবোধ এবং ঐক্যের প্রতীক আসলে এটি। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটির সেই গুরুত্ব যেন মারাত্মকভাবে খর্ব হতে চলেছে।
আটলান্টিকের বন্ধন কী ছিন্ন হতে চলেছে?
বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ন্যাটো জোটের বিভিন্ন সদস্য দেশের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা জোটে কে কী পরিমাণ অর্থ দেয় সেটি নিয়ে।
এটা সত্যি যে, ন্যাটোর যে বিশাল ব্যয়ভার, সেটা কে কতটা বহন করবে তা নিয়ে বহু বছর ধরেই বিতর্ক চলছে। এ বিষয়টি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম প্রশ্ন তুলছেন, ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু যে ভঙ্গীতে এবং কায়দায় ট্রাম্প এর সমাধান করতে চাইছেন, সেটা একেবারেই নতুন।
ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো একমত হয়েছিল যে, ২০২৪ সাল নাগাদ প্রত্যেক দেশ তাদের জিডিপির মোট দুই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করবে। প্রতিরক্ষা খাতে অনেক দেশই এরপর তাদের ব্যয় বাড়াচ্ছে। কিন্তু অনেক দেশই তাদের টার্গেট থেকে বেশ পেছনে আছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃষ্টিতে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে জার্মানি। এ মাসের শুরুতে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেলকে উদ্দেশ্য করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, আমি জানি না জার্মানিকে সুরক্ষা দিয়ে আমেরিকা নিজে কতটা সুরক্ষা পায়।
জার্মানির সঙ্গে রাশিয়ার গ্যাস চুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছিলেন, জার্মানি রাশিয়াকে শত শত কোটি ডলার দেয়। আর আমরা কিনা (ন্যাটো জোটের) পুরো খরচ টানছি। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন জোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তখন তা ওয়াশিংটনের অনেক ইউরোপীয় মিত্রকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
কিন্তু রাশিয়া আসলে কত বড় হুমকি?
ন্যাটো জোট বিগত বছরগুলোতে যে ধরনের কৌশলগত হুমকি মোকাবেলা করেছে, তা এখন বদলে যাচ্ছে। আগের হুমকির ধরণটা ছিল স্পষ্ট। কিন্তু এখন তা অনেক বেশি জটিল। রাশিয়ার পুনরুত্থান থেকে শুরু করে সাইবার যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ থেকে ব্যাপক অভিবাসন- এরকম নানা ধরণের হুমকির মুখে ন্যাটো।
এমনকি রাশিয়ার হুমকিও একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। এটি সেই পুরনো আমলের সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে-দৃশ্যটা ঠিক এরকম নয়। বরং এই হুমকি সাইবার হামলা থেকে শুরু করে, প্রচার যুদ্ধ, যার মাধ্যমে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা যায়।
পশ্চিমা দেশগুলো স্পষ্টভাবে বিশ্বাস করে, রাশিয়া দরকার হলে কাউকে হত্যার জন্য আততায়ী পর্যন্ত পাঠাতে পারে। ২০০৬ সালে লন্ডনে আলেক্সান্ডার লিটভিনেনকো হত্যাকান্ড কিংবা এ বছর এক সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তার মেয়ের ওপর নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের উদাহারণ টানছেন তারা।
রাশিয়া তুলনামূলকভাবে দুর্বল দেশ। কিন্তু দরকার হলে সামরিক শক্তি প্রয়োগে রাশিয়া পিছপা হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। জর্জিয়া এবং ইউক্রেনে গত কয়েক বছরে যা ঘটেছে, সেটা অন্তত তাই বলে।
আর ন্যাটো যে নতুন নতুন দেশকে সদস্য করার মাধ্যমে তার সীমানা বাড়াচ্ছে, সেটা তো অবশ্যই রাশিয়াকে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
ট্রাম্পের আমলে ন্যাটো কিী টিকবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প সবকিছুতে যেভাবে মুখের ওপর কথা বলেন, সেটা বিশ্বরাজনীতিতে একেবারেই নতুন। যুক্তরাষ্ট্র এমন এক পরাশক্তি, যাদের সারা দুনিয়া জুড়ে নানা ধরনের কৌশলগত স্বার্থ আছে। অন্যদিকে রাশিয়ার দিক থেকে হুমকির ধরণটা এখন ভিন্ন। এই হুমকি আগের কায়দায় ব্যাপক সৈন্যসমাবেশ ঘটিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
ইউরোপ হয়তো নিজের প্রতিরক্ষায় আরও বেশি অর্থ খরচ করতে সক্ষম হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মুখে যত কথাই বলুন, যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এখন সামরিকভাবে ইউরোপে আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও নেটো জোটের একনিষ্ঠ সমর্থক। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস ম্যাটিস তাদের একজন।
কিন্তু আটলান্টিকের দুই তীরের এই মৈত্রীকে ট্রাম্প নিজে কতটা গুরুত্ব দেন? অনেকেই বলছেন, তিনি এটাকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। ন্যাটো জোট যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা কি তিনি আদৌ বোঝেন?
উত্তরে অনেকেই বলবেন, মোটেই না। ন্যাটো জোটের এই শীর্ষ সম্মেলন শেষে ট্রাম্প যাবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এটি নিয়ে বিরাট ধাঁধাঁয় আছে ন্যাটোর মিত্ররা।
সেখানে গিয়ে কি ছাড় দেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প? ন্যাটোর ভেতর এই টানাপোড়েন থেকে মস্কো কি বার্তা পাবে?
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে নেটো জোট যে টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে, তাতে রীতিমত হাল ছেড়ে দিয়েছেন জোটের কূটনীতিকরা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন, তখন কী হবে?
কূটনীতিকদের আশংকা, ন্যাটো জোট তখন হয়তো একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে এবং আটলান্টিকের দুই তীরের মৈত্রী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। -বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন