পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় হাঁড়কাপানো শীতে শীতল পানিতে জীবিকার লড়াই
বরফ জল। শীতের ভোর। হাঁড়কাপানো শীতে জীবিকার তাগিদ। পাথর তুলতে এই বরফ গলা জলে নেমে পড়েন শতশত দলবাধা শ্রমিক। যেমন পাথরের শরীর, শীত স্পর্শ করে না। পেটের ক্ষুধা আর পরিবারের মৌলিকা চাহিদা পূরণ করতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানকৌড়ি পাখির মতো ডুবে ডুবে তুলেন পাথর। সন্ধ্যায় হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে উত্তোলিত পাথর মহাজনের কাছে বিক্রি বাজার সদায় করে অন্ন জুটে পরিবারের মুখে। এ যেন বরফ জলে জীবিকার লড়াই। এ চিত্র দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার সীমান্ত প্রবাহিত নদী মহানন্দার।
দেড়লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় অর্ধ-লক্ষাধিক পাথর শ্রমিক। এ পাথর উত্তোলিত হচ্ছে নদী থেকে। দু’সীমান্তে বুক চিরে প্রবাহিত নদী মহানন্দায় হাজারো শ্রমিকের জীবিকার বিশাল ভান্ডার। কেউ কেউ ভাগ্যদেবতাও মনে করে মহানন্দাকে। প্রতিদিন লাখ লাখ সিএফটি নুড়ি পাথর তোলা হচ্ছে এ নদী থেকে। ভোর সকালে বরফগলা ঠান্ডা পানিতেই শ্রমিকরা দলবেধে হাওয়ায় ফুলানো গাড়ির টিউব, লোহার খাটাল (চালুনী) ও লোহার রড নিয়ে নেমে পড়ছেন নদীতে। দিনভর চলে পাথর উত্তোলন। সেই পাথর ভাসানো টিউবের ঢাকিতে করে নদীর কিনারে এনে সেখান থেকে দু’কাঁধে ভরে তীরে স্তূপ করে।
সন্ধ্যায় মহাজনের কাছে বিক্রি করা টাকায় জোটে তাদের পরিবারের আহার। দিন শেষে প্রতিদিন মজুরি হিসেবে মিলে ৫’শ থেকে ৭’শ টাকা। আর উপার্জনের অন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিদিন শীতকে উপেক্ষা করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বরফ গলা পানিতে নেমে নুড়ি পাথর কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা।
একদল পাথর শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সকাল ৮টায় নদীতে নেমেছেন। পানি খুব ঠান্ডা। কিছু করার নেই, বাইরে কাজ নেই।
পাথর শ্রমিক উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের আমজুয়ানী গ্রামের তরিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে এই মহানন্দা নদীই তাদের রোজগারের উপায় হয়েছে। আমার চার মেয়ে এক ছেলে। সকালে নদীর পানি বরফের মতো ঠান্ডা। কাজ না করলে খাব কী। একই কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের কালদাসপাড়া গ্রামের বেলাল হোসেন নামে আরেক শ্রমিক জানান, ঘরে স্ত্রীসহ চার মেয়ে। সন্তানের ভরণ-পোষণ চলে এই পাথর জীবিকার ওপর। দিনভর দলের সঙ্গে বরফগলা ঠান্ডা পানিতে পাথর তুলে সন্ধ্যায় পারিশ্রমিক নিয়ে পরিবারের অন্ন বস্ত্র শিক্ষাসহ যাবতীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করেন।
এতো ঠান্ডা পানিতে কাজ করছেন, পরে অসুখ ধরে না প্রশ্ন করলে তরিকুল আরো বেলাল বলেন, ‘হ্যাঁ ভাই, সর্দি-জ্বর তো হচে। কয়দিন জ্বরে ছিনু। কাম না করে উপায় নাই। অনেক সময় তাদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)এর বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। কখনো কখনো বন্ধ হয়ে যায় পাথর উত্তোলনের কাজ। এতে কমে যায় রুজি-রোজগার। তবুও প্রাত্যহিক ঝুঁকি নিয়েই পাথর তুলতে নেমে যায় নদীর বরফগলা জলে।’
নদী মহানন্দার পাথর শ্রমিক ছাড়াও এ নদীর তীরে পাথর নেটিং, শোটিং ও ক্রাশিং এর কাজ করছে শতশত নারী পাথর শ্রমিক। তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার নদীর তীরসহ সড়কের উভয় পার্শ্বে চলে পাথর লোড-আনলোড, নেটিং, শোটিং ও ক্রাশিংয়ের কাজ। এসব কাজে জড়িত শতশত নারী-পুরুষ পাথর শ্রমিক। তারাও ভোর সকালে ঘরের গৃহস্থালির কাজ সেরে হিম-কুয়াশার ভেতরেই ঘর থেকে বের হয়ে যান কাজের উদ্দেশ্যে। ভোর সকালে যখন কুয়াশা ঢাকা চারপাশ, কনকনে শীতে হাত অবশ হয়ে আসে। কিন্তু সেই অবশ করা ঠান্ডাও হার মানে এসব কর্মজীবী বীর শ্রমিকদের কাছে। অটোভ্যান ও অটোরিকশা ও কেউ সাইকেল চালিয়ে যোগ দেন কাজে। সকাল থেকে সন্ধ্যা।
দিন শেষে এসব শ্রমিকরা মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজার করে ঘরে ফিরে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটাতে।
কথা হয় ক্রাশিং মেশিনে পাথর ভাঙা কাজে নিয়োজিত ওই উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া গ্রামের আজগড় আলী’র স্ত্রী সামিনা বেগমের সাথে।
তিনি বলেন, ‘ফজরের আজান শুনে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর তাড়াহুড়ো করে নিজের ও সন্তানের জন্য রান্না করতে হয়। সন্তানদের কোনো দিন খাইয়ে কোনো দিন না খাইয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় তাকে। দেরি করে কাজে পৌঁছালে মহাজনের গালি শুনতে হয়। কোনো কোনো দিন দেরি করার কারণে কাজেই নেওয়া হয় না।’
চোখের পানি ফেলে উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের কুড়ানগছ গ্রামের স্বামী হার বাচ্চাই বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী প্রায় দশ বছর মারা গেছেন। আমার ছেলে বিয়ে করে আলাদা খাইছেন, আমি নিরুপায় হয়ে পাথর ভাঙ্গা মেশিনে কাজ নিজের পেটের আহার জোগাচ্ছি। শুধু তাই নয়, শতশত নারী কাজ করছে জীবিকা ও সংসারের তাগিদে। এদের সঙ্গে নানা বয়সী পুরুষ শ্রমিকরাও। সমতালে সম্প্রীতির বন্ধনে শীতকে তুচ্ছ মনে করে কাজ করে যাচ্ছে। জীবনের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। জীবনযুদ্ধে এসব অসহায় মানুষগুলো ঝুঁকি নিয়ে দিনভর যুদ্ধ করে স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, সীমান্তবর্তী এই উপজেলায় তেমন কোনো শিল্পকারখানা গড়ে না ওঠায় অভাবী মানুষের কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। তেঁতুলিয়া পাথর ও চা শিল্পখ্যাত এলাকা। দুই বাংলার বুক চিরে প্রবাহিত মহানন্দা নদীতে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। সরকারিভাবে এই উপজেলায় বাসস্থানের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। অভাবের সময়ে মানুষদের নানাভাবে সরকারি অনুদানের আওতায় আনা হচ্ছে। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের মেধাবী সন্তানদের সহযোগিতা করছি। আমরা চেষ্টা করবো প্রচন্ড হাড়কাঁপা শীতে শীতবস্ত্র দিয়ে তাদের উষ্ণতা দিতে। বন্দর ব্যবস্থাপনা জোরদার করে অনেক মানুষকে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এসব মানুষের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ জানান, গত ১০ দিন ধরেই দেশের সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ৮-৯-এর মধ্যে রেকর্ড হচ্ছে এ অঞ্চলে। তবে বুধবার সকালে সর্বনিন্ম তাপমাত্রা রেকর্ড ধরা হয় ১১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে শুক্রবার রেকর্ড হয় ২৩ দশমিক ৩ডিগ্রি। মঙ্গলবার রাত থেকে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে প্রবাহিত পূবালী ঠান্ডা বাতাস প্রতিঘণ্টায় ৪ থেকে ৫ নটিক্যাল মাইল বেগে বইছে। এ কারণেই তীব্র ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এর তীব্রতা আরও বাড়বে বলে জানান তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন